[১] বলা হয়েছে, ‘আর তাদের অঙ্গিকার ভঙ্গের কারণে এবং...’ কিন্তু এর কারণে কি হয়েছে সেটা বলা হয় নি। বরং উত্তরটি উহ্য রাখা হয়েছে। সূরা আল-মায়িদাহ এর ১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর তাদের অঙ্গিকার ভঙ্গের জন্য আমরা তাদেরকে লা’নত করেছিলাম’। সুতরাং এখানেও একই অর্থ গ্রহণ করা যায়। যাজ্জাজ বলেন, আয়াতের উত্তর হচ্ছে, তাদের অঙ্গিকার ভঙ্গের কারণে তাদের উপর আমরা অনেক হালাল বস্তু হারাম করেছি। কারণ, ১৬০ নং আয়াতে তা-ই বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো মুফাসসিরের মতে, এ আয়াতের শেষে বর্ণিত, ‘বরং আল্লাহ তাদের উপর মোহর করেছেন’ এ কথাটিই উক্ত কথার উত্তর । আবার কারও কারও মতে, আয়াতের শেষে বর্ণিত, ‘কেবল অল্প সংখ্যকই ঈমান আনবে’ এটাই হচ্ছে পূর্ববর্তী কথার উত্তর। [ফাতহুল কাদীর]
[১] মারইয়ামের উপর চাপানো তাদের গুরুতর অপবাদ কী ছিল তা এখানে বর্ণনা করা হয় নি। অন্যত্র এসেছে যে, তারা মারইয়ামকে ব্যভিচারের অপবাদ দিতে ক্রটি করে নি। আল্লাহ বলেন, “তারপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হল; তারা বলল, “হে মারইয়াম! তুমি তো এক অদ্ভুত জিনিস নিয়ে এসেছ।” [সূরা মারইয়াম ২৭]
এখানে অঘটন বলতে তারা ব্যভিচারের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছিল। কারণ পরবর্তী আয়াতে মারইয়ামের বাবা খারাপ লোক না হওয়া এবং মা-ও বেশ্যা না হওয়া বলার মাধ্যমে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। [আদওয়াউল বায়ান]
[১] এখানে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে যে, তারা ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে হত্যাও করতে পারেনি, শুলেও চড়াতে পারেনি, বরং আসলে ওরা সন্দেহে পতিত হয়েছিল। কিন্তু তাদের সন্দেহ কী ছিল এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে, সব বর্ণনার সার কথা হচ্ছে, ইয়াহুদীরা যখন ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর হলো, তখন তার ভক্ত-সহচরবৃন্দ এক স্থানে সমবেত হলেন। ঈসা ‘আলাইহিস সালামও সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন চার হাজার ইয়াহুদী দূরাচার একযোগে গৃহ অবরোধ করলো। তখন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম স্বীয় ভক্ত অনুচরগণকে সম্বোধন করে বললেন, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ এই ঘর থেকে বের হতে ও নিহত হতে এবং আখেরাতে জান্নাতে আমার সাথী হতে প্রস্তুত আছো কি? জনৈক ভক্ত আত্মোৎসর্গের জন্য উঠে দাঁড়ালেন। ঈসা ‘আলাইহিস সালাম নিজের জামা ও পাগড়ী তাঁকে পরিধান করালেন। অতঃপর তাঁকে ঈসা ‘আলাইহিস সালামের সাদৃশ করে দেয়া হলো। যখন তিনি ঘর থেকে বের হলেন, তখন ইয়াহুদীরা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম মনে করে তাঁকে বন্দী করে নিয়ে গেল এবং শুলে চড়িয়ে হত্যা করলো। অপরদিকে ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে আল্লাহ্ তা’আলা আসমানে তুলে নিলেন।
এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, ইয়াহুদীরা এক লোককে ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে হত্যা করার জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু ইতোপূর্বে আল্লাহ্ তা'আলা তাঁকে আকাশে তুলে নেয়ায় সে তার নাগাল পেল না। বরং ইতিমধ্যে তার নিজের চেহারা ঈসা ‘আলাইহিস সালামের মত হয়ে গেল। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল তখন অন্যান্য ইয়াহুদীরা তাকেই ঈসা ‘আলাইহিস সালাম মনে করে পাকড়াও করলো, এবং শুলে বিদ্ধ করে হত্যা করলো। উক্ত বর্ণনা দু’টির মধ্যে যে কোনোটিই সত্য হতে পারে। কুরআনুল কারীম এ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু ব্যক্ত করেনি। অতএব, প্রকৃত ঘটনার সঠিক খবর একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই জানেন। অবশ্য কুরআনুল কারীমের আয়াত ও তাফসীর সংক্রান্ত বর্ণনার সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, প্রকৃত ঘটনা ইয়াহুদী-খৃষ্টানদেরও অজ্ঞাত ছিল। তারা চরম বিভ্রান্তির আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে শুধু অনুমান করে বিভিন্ন উক্তি ও দাবী করছিল। ফলে উপস্থিত লোকদের মধ্যেই চরম মতভেদ ও বিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে যে, যারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে নানা মত পোষন করে নিশ্চয় এ ব্যাপারে তারা সন্দেহে পতিত হয়েছে। তাদের কাছে এ সম্পর্কে কোনো সত্যনির্ভর জ্ঞান নেই। তারা শুধু অনুমান করে কথা বলে। আর তারা যে ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে হত্যা করেনি, এ কথা সুনিশ্চিত। বরং আল্লাহ্ তা’আলা তাকে নিরাপদে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন।
কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে যে, সম্বিত ফিরে পাওয়ার পর কিছু লোক বললো, আমরা তো নিজেদের লোককেই হত্যা করে ফেলেছি। কেননা নিহত ব্যক্তির মুখমণ্ডল ঈসা ‘আলাইহিস সালামের মত হলেও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্য রকম। তদুপরি এ ব্যক্তি যদি ঈসা ‘আলাইহিস সালাম হয়, তবে আমাদের প্রেরিত লোকটি গেল কোথায়? আর এ ব্যক্তি আমাদের হলে ঈসা ‘আলাইহিস সালামই বা কোথায় গেলেন? মোটকথা, ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে ইয়াহুদী ও নাসারা যারাই কথা বলে তারাই বিভ্রান্তিতে লিপ্ত। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান নেই।
[১] “আল্লাহ অতি পরাক্রমশালী, হিকমতওয়ালা (প্রজ্ঞাময়)।“ ইয়াহুদীরা ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে হত্যা করার যত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তই করুক না কেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’আলা যখন তাঁর হেফাযতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন তখন তাঁর অসীম কুদরত ও অপার হেকমতের সামনে তাদের অপচেষ্টার কি মূল্য আছে? আল্লাহ্ তা’আলা প্রজ্ঞাময়, তাঁর প্রতিটি কাজে নিগূঢ় রহস্য বিদ্যমান রয়েছে। জড়পূজারী বস্তুবাদীরা যদি ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে সশরীরে আকাশে উত্তোলনের সত্যটি উপলব্ধি করতে না পারে, তবে তা তাদেরই দুর্বলতার প্রমাণ।
[১] অর্থাৎ ইয়াহুদীরা ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও শক্রতার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে যদিও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করে না এবং ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে, এমনকি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তকেও অস্বীকার করে, কিন্তু তাদের মৃত্যুর পূর্বে এমন এক সময় আসবে, যখন তাদের দৃষ্টির সম্মুখে সত্য উন্মোচিত হবে, তখন তারা যথার্থই বুঝতে পারবে যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তাদের ধারণা একান্তই ভ্রান্তিপূর্ণ ছিল। এ আয়াতের (موته) অর্থাৎ ‘মৃত্যুর পূর্বে’ শব্দে ইয়াহুদীদের মৃত্যুর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ অবস্থায় অত্র আয়াতের তাফসীর এই যে, প্রত্যেক ইয়াহুদীই তার অন্তিম মুহুর্তে যখন আখেরাতের দৃশ্যাবলী অবলোকন করবে, তখন ঈসা ‘আলাইহিস সালামের নবুওয়তের সত্যতা ও নিজেদের বাতুলতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে এবং তার প্রতি ঈমান আনয়ন করতে বাধ্য হবে। কিন্তু তখনকার ঈমান তাদের আদৌ কোনো উপকারে আসবে না; যেমন লোহিত সাগরে ডুবে মরার সময় ফিরআওনের ঈমান ফলপ্রসূ হয়নি। এ আয়াতের দ্বিতীয় তাফসীর যা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের বিপুল জামা’আত কর্তৃক গৃহীত ও সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত হয়েছে, তা হলো (موته) ‘তার মৃত্যু’ শব্দের সর্বনামে ঈসা ‘আলাইহিস সালামের মৃত্যু বোঝানো হয়েছে। এ অবস্থায় অত্র আয়াতের তাফসীর হলো, কিতাবীরা এখন যদিও ঈসা ‘আলাইহিস সালামের প্রতি সত্যিকার ঈমান আনে না, ইয়াহুদীরা তো তাকে নবী বলে স্বীকারই করে না, বরং ভণ্ড, মিথ্যাবাদী ইত্যকার আপত্তিকর বিশেষণে ভূষিত করে। অপরদিকে নাসারারা যদিও ঈসা মসীহ্ ‘আলাইহিস সালামকে ভক্তি ও মান্য করার দাবীদার; কিন্তু তাদের মধ্যে একদল ইয়াহুদীদের মতই ঈসা ‘আলাইহিস সালামের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার এবং মৃত্যুবরণ করার কথায় স্বীকৃতি প্রদান করে চরম মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছে। তাদের আরেক দল অতিভক্তি দেখাতে গিয়ে ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে স্বয়ং আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র বলে ধারণা করে বসেছে। কুরআনুল কারীমের এই আয়াতে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে যে, ইয়াহুদী ও নাসারারা বর্তমানে যদিও ঈসা ‘আলাইহিস সালামের প্রতি যথাযথ ঈমান রাখে না, বরং শৈথিল্য বা বাড়াবাড়ি করে, কিন্তু কিয়ামতের নিকটবর্তী যুগে তিনি যখন পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন, তখন এরাও তাঁর প্রতি পুরোপুরি ঈমান আনয়ন করবে। নাসারারা তখন মুসলিমদের মত সহীহ আকীদা ও বিশ্বাসের সাথে ঈমানদার হবে। ইয়াহুদীদের মধ্যে যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে, তাদেরকে নিধন ও নিশ্চিহ্ন করা হবে, অবশিষ্টরা ইসলাম গ্রহণ করবে। তখন সমগ্র দুনিয়া থেকে সর্বপ্রকার কুফরী ধ্যান-ধারণা, আচার-অনুষ্ঠান উৎক্ষিপ্ত হয়ে যাবে; সর্বত্র ইসলামের একচ্ছত্র প্রাধান্য কায়েম হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঈসা ইবন মারইয়াম ‘আলাইহিস সালাম একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে অবশ্যই অবতরণ করবেন। তিনি দাজ্জালকে কতল করবেন, শুকর নিধন করবেন এবং ক্রুশকে চুরমার করবেন। তখন একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করা হবে।’ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু আরো বলেন, তোমরা ইচ্ছা করলে এখানে কুরআনুল কারীমের এ আয়াত পাঠ করতে পার যাতে বলা হয়েছে, “আহলে-কিতাবদের মধ্যে কেউ অবশিষ্ট থাকবে না, বরং ওরা তাঁর মৃত্যুর পূর্বে অবশ্যই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।” [বুখারী ৩৪৪৮]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “এর অর্থ ঈসা ‘আলাইহিস সালামের মৃত্যুর পূর্বে।’ এ বাক্যটি তিনি তিনবার উচ্চারণ করেন। অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তখন তোমাদের কেমন লাগবে? যখন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম তোমাদের মাঝে আগমন করবেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে ঈমাম হবেন।” [বুখারী ৩৪৪৯]
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ! ‘অবশ্যই ইবন মারইয়াম ‘ফাজ্জ আর রাওহা’ থেকে হজ্জ বা উমরা অথবা উভয়টির জন্যই ইহরাম বাঁধবেন।” [মুসলিম ১২৫২]
অন্য হাদীসে এসেছে, “ইবন মারইয়াম দাজ্জালকে ‘বাবে লুদ’ এ হত্যা করবে।” [তিরমিয়ী ২২৪৪] মোটকথা, কিয়ামতের পূর্বে ঈসা ‘আলাইহিস সালামের আগমনের ব্যাপারটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যখন তিনি আসবেন তখন সমস্ত বিভ্রান্ত নাসারা ঈসা ‘আলাইহিস সালামের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হবে।
[২] কাতাদা বলেন, এর অর্থ তিনি সাক্ষ্য দিবেন যে, তিনি তাদের কাছে তার রবের রিসালত পৌছে দিয়েছেন এবং তিনি যে বান্দা এ কথার স্বীকৃতি প্রদান করবেন। [তাবারী]
[১] ইসলামী শরীআতেও কোনো কোনো দ্রব্য পানাহার করা হারাম ঘোষিত হয়েছে। তবে তা শারিরিক বা আধ্যাত্মিক ক্ষতিকর হওয়ার কারণে। পক্ষান্তরে ইয়াহুদীদের জন্য কোনো দৈহিক বা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে ক্ষতিকর হওয়ার কারণে পবিত্র দ্রব্য হারাম করা হয়নি, বরং তাদের অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ সেগুলো হারাম করা হয়েছিল। তাদের উপর কোনো কোনো জিনিস হারাম করা হয়েছিল তা সূরা আল-আন’আমের ১৪৬ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
[১] এ আয়াতে কতিপয় মহান ব্যক্তির জন্য যে বিপুল প্রতিদানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে, তা তাঁদের ঈমান ও সৎকর্মের কারণে। তবে অবশ্যই ঈমানের সাথে মৃত্যুর সৌভাগ্য হতে হবে।