[১] কাতাদা বলেন, এখানে ইয়াহুদীদেরকেই বলা হচ্ছে। যেমনিভাবে তাদের পুর্বপুরুষদের তাওবা কবুলের জন্য মূসা ‘আলাইহিস সালাম কর্তৃক তাদের নিজেদের হত্যা করার নির্দেশ ছিল, তেমনি নির্দেশ যদি তাদের জন্যও আসত, তবে তারা তা অবশ্যই অমান্য করত। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
[১] সিদ্দীক বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায় যে পরম সত্যনিষ্ঠ ও সত্যবাদী। তার মধ্যে সততা ও সত্যপ্রিয়তা পূর্ণমাত্রায় বিরাজিত থাকে। নিজের আচার আচরণ ও লেনদেনে সে হামেশা সুস্পষ্ট ও সরল-সোজা পথ অবলম্বন করে। সে সবসময় সাচ্চাদিলে হক ও ইনসাফের সহযোগী হয়। সত্য ও ন্যায়নীতি বিরোধী যে কোনো বিষয়ের বিরুদ্ধে সে পর্বত সমান অটল অস্তিত্ব নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে সামান্যতম দুর্বলতাও দেখায় না। সে এমনই পবিত্র ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হয় যে, তার আত্মীয়-অনাত্বীয়, বন্ধু-শক্র, আপন-পর কেউই তার কাছ থেকে নির্লজ্জ ও নিখাদ সত্যপ্রীতি, সত্য-সমর্থন ও সত্য-সহযোগিতা ছাড়া আর কিছুরই আশংকা করে না। কোনো রকম দ্বিধা-সংকোচ ও বিরোধিতা তাদের মনে কখনও স্থান পায় না। যেমন, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমূখ।
[২] সালেহীন বা সৎকর্মশীল বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যে তার নিজের চিন্তাধারা, আকীদা-বিশ্বাস, ইচ্ছা, সংকল্প, কথা ও কর্মের মাধ্যমে সত্য-সরল পথে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এর সাথে নিজের জীবনে সৎ ও সুনীতি অবলম্বন করে। আর যারা প্রকাশ্য ও গোপন সব ক্ষেত্রেই সৎকর্মসমূহের অনুবর্তী।
[৩] জান্নাতের পদমর্যাদাসমূহ আমলের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। জান্নাতীদের পদমর্যাদা তাঁদেরই আমল তথা কৃতকর্ম অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। প্রথম শ্রেণীর লোকদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা নবী-রাসূলগণের সাথে জান্নাতের উচ্চতর স্থানে জায়গা দেবেন এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকদেরকে নবীগণের পরবর্তী মর্যাদার লোকদের সাথে স্থান দেবেন। তাদেরকেই বলা হয় ‘সিদ্দীকীন’। অতঃপর তৃতীয় শ্রেণীর লোকেরা থাকবেন শহীদগণের সাথে। আর চতুর্থ শ্রেণীর লোকেরা থাকবেন সালেহীনদের সাথে। সারকথা, আল্লাহ তা’আলার আনুগত্যশীল বান্দাগণ সে সমস্ত মহান ব্যক্তিদের সাথে থাকবেন, যারা আল্লাহ্ তা'আলার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত ও মকবুল। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “জান্নাতবাসীরা নিজেদের জানালা দিয়ে উপরের শ্রেণীর লোকদেরকে তেমনিভাবে দেখতে পাবে, যেমন পৃথিবীতে তোমরা সূদুর দিগন্তে নক্ষত্রকে দেখ। বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল! এরা কি শুধু নবী-রাসূলগণ? রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অবশ্যই না, এমন কিছু লোক যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং নবী-রাসূলদের সত্যায়ন করেছে।” [বুখারী ৩২৫৬, মুসলিম ২৮৩১]
তাই যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভে ধন্য হতে চাইবে, তাদেরকে তা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসার মাধ্যমেই লাভ করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার জিজ্ঞাসা করা হল যে, ‘সে লোকটির মর্যাদা কেমন হবে, যে লোক কোনো গোষ্ঠীর ভালোবাসা পোষণ করে, কিন্তু আমলের বেলায় এ দলের নির্ধারিত মান পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি?’ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, প্রতিটি লোকই যার সাথে তার ভালোবাসা, তার সাথে থাকবে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, পৃথিবীতে কোনো কিছুতেই আমি এতটা আনন্দিত হইনি যতটা এ হাদীসের কারণে আনন্দিত হয়েছি। কারণ, এ হাদীসে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যাদের গভীর ভালোবাসা রয়েছে তাঁরা হাশরের মাঠেও তাঁর সাথেই থাকবেন। [বুখারী ৬১৬৭, মুসলিম ২৬৩৯]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয় আপনি আমার কাছে আমার নিজের আত্মার চেয়েও প্রিয়। আপনি আমার নিকট আমার পরিবার-পরিজন, সম্পদ, সন্তান-সন্ততিদের থেকেও প্রিয়। আমি আমার ঘরে অবস্থানকালে আপনার কথা স্মরণ হলে যতক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে না দেখি ততক্ষণ স্থির থাকতে পারি না। যখন আমি আমার ও আপনার মৃত্যুর কথা স্মরণ করি তখন বুঝতে পারি যে, আপনি নবীদের সাথে উঁচু স্থানে অবস্থান করবেন। আর আমি যদি জান্নাতে প্রবেশ করি তবে আপনাকে দেখতে না পাওয়ার আশংকা করছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীর কথার তাৎক্ষনিক কোনো জওয়াব দিলেন না। শেষ পর্যন্ত জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম এ আয়াত নাযিল করলেন। [আল-মুজামুস সাগীর লিত তাবরানী ১/২৬; মাজমাউদ যাওয়ায়িদ ৭/৭]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, “আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি শুনেছিলাম যে, নবীদেরকে মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়া ও আখেরাত যে কোনো একটি বেছে নেয়ার অধিকার দেয়া হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অসুস্থতার পর মারা গেলেন, সে অবস্থায় তার মুখ থেকে এ আয়াত শুনতে পেলাম। তখন আমি বুঝলাম যে, তাকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। আর তিনি আখেরাত বেছে নিয়েছেনা।” [বুখারী ৪৪৩৫; মুসলিম ২৪৪৪]
দশম রুকূ‘
[১] আয়াতের প্রথমাংশে জিহাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং আয়াতের দ্বিতীয় অংশে জিহাদে অংশ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে বেশকিছু শিক্ষা রয়েছে – (১) কোনো ব্যাপারে বাহ্যিক উপকরণ অবলম্বন করা তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতার পরিপন্থী নয়। (২) অস্ত্র সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হলেও এমন প্রতিশ্রুতি কিন্তু দেয়া হয়নি যে, এ অস্ত্রের কারণে তোমরা নিশ্চিতভাবেই নিরাপদ হতে পারবে । এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, বাহ্যিক উপকরণ অবলম্বন করাটা মূলতঃ মানসিক স্বস্তি লাভের জন্যই হয়ে থাকে। (৩) এ আয়াতে প্রথমে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ অতঃপর জিহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার সুশৃংখল নিয়ম বাতলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা যখন জিহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে, তখন একা একা বাহির হবেনা, বরং ছোট ছোট দলে বাহির হবে কিংবা (সম্মিলিত) বড় সৈন্যদল নিয়ে বাহির হবে। তার কারণ, একা একা যুদ্ধ করতে গেলে ক্ষতির আশংকা রয়েছে। শক্ররা এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে মোটেই শৈথিল্য করে না।
[১] মুজাহিদ বলেন, এ আয়াত ও পূর্ববর্তী আয়াতে যাদেরকে বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে মুনাফিক, যারা সাহাবাদের সাথে মিশে থাকত। [আত-তাফসীরুস সহীহ] যুদ্ধের ঘোষণা শোনার সথে সাথেই তাদের মধ্যে গড়িমসি শুরু হত। এরপর যদি মুসলিমদের কোনো বিপদ হতো, তখন তারা বলত যে, তাদের সাথে না থাকাটা আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, এ অবস্থায় তারা খুশীও প্রকাশ করত। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মঙ্গল হলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর তোমাদের অমঙ্গল হলে তারা তাতে আনন্দিত হয়।” [সূরা আলে-ইমরান ১২০]
“আপনার মংগল হলে তা ওদেরকে কষ্ট দেয় এবং আপনার বিপদ ঘটলে ওরা বলে, “আমরা তো আগেই আমাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম’ এবং ওরা উৎফুল্ল চিত্তে সরে পড়ে।” [আত-তাওবাহ্: ৫০] পক্ষান্তরে যখন মুসলিমদের কোনো বিজয়ের কথা শুনত, তখন তারা বোল পাল্টিয়ে ফেলত যাতে করে যুদ্ধলন্দ সম্পদে ভাগ বসাতে পারে। যদিও মুসলিমদের বিজয় তাদের মনের জ্বালা বাড়িয়ে দেয়। [আদওয়াউল বায়ান]