[১] মুসা আলাইহিস সালামকে দু’টি জিনিসের দাওয়াত সহকারে ফেরাউনের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এক. আল্লাহর বন্দেগী তথা ইসলাম গ্রহণ করো। দুই. বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়, যারা আগে থেকেই মুসলিম ছিল, তাদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করে তাদেরকে মুক্ত করে দাও। কুরআনের কোথাও এ দু’টি দাওয়াতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এক সাথে আবার কোথাও স্থান-কাল বিশেষে আলাদা আলাদাভাবে এদের উল্লেখ এসেছে।
[১] সারকথা, আমার কথার উপর তোমাদের বিশ্বাস এজন্য স্থাপন করা কর্তব্য যে, আমার সত্যতা তোমাদের সবার সামনে ভাস্কর; আমি কখনো মিথ্যা বলিওনি বলতে পারিও না। কারণ, নবী-রাসূলগণ খেয়ানত ও যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত নিষ্পাপ। তাছাড়া শুধুমাত্র তাই নয় যে, আমি কখনো মিথ্যা বলিনি; বরং আমার দাবীর সপক্ষে আমার মু'জিযাসমূহ প্রমাণ হিসাবে রয়েছে। সুতরাং এসব বিষয়ের প্রেক্ষিতে তোমরা আমার কথা শুন এবং আমার কথা মান। বনী ইসরাঈলকে অন্যায় দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে আমার সাথে দিয়ে দাও। কিন্তু ফিরআউন অন্য কোনো কথাই লক্ষ্য করল না; মু'জিযা দেখার দাবী করতে লাগল এবং বলল: বাস্তবিকই যদি তুমি কোনো মু'জিযা নিয়ে এসে থাক, তাহলে তা উপস্থাপন কর যদি তুমি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাক।
মূসা আলাইহিস সালাম তার দাবী মেনে নিয়ে স্বীয় লাঠিখানা মাটিতে ফেলে দিলেন, আর অমনি তা এক বিরাট অজগরে পরিণত হয়ে গেল। ‘সূ’বান’ বলা হয় বিরাটকায় অজগরকে। আর তার গুণবাচক ‘মুবীন’ শব্দ উল্লেখ করে বলে দেয়া হয়েছে যে, সে লাঠির সাপ হয়ে যাওয়াটা এমন কোনো ঘটনা ছিল না যা অন্ধকারে কিংবা পর্দার আড়ালে ঘটে থাকবে যা কেউ দেখে থাকবে, কেউ দেখবে না। সাধারণতঃ যা জাদুকরদের বেলায় ঘটে থাকে। বরং এ ঘটনাটি সংঘটিত হল প্রকাশ্য দরবারে সবার সামনে।
[১] نزع অর্থ হচ্ছে কোনো একটি বস্তুকে অপর একটি বস্তুর ভেতর থেকে কিছুটা বল প্রয়োগের মাধ্যমে বের করা। অর্থাৎ নিজের হাতটিকে টেনে বের করলেন। এখানে কিসের ভেতর থেকে বের করলেন তা উল্লেখ করা হয়নি। অন্য আয়াতে দু’টি বস্তুর উল্লেখ রয়েছে। এক স্থানে এসেছে স্বীয় হাত গলাবন্ধ কিংবা বগলের নীচ থেকে অর্থাৎ কখনো গলাবন্ধর ভিতরে ঢুকিয়ে তা বের করলে আবার কখনো বগল-তলে দাবিয়ে সেখান থেকে বের করে আনলে এ মু'জিযা প্রকাশ পেত অর্থাৎ সে হাতটি দর্শকদের সামনে প্রদীপ্ত হতে থাকত।
[২] তখন ফির’আউনের দাবীতে মূসা আলাইহিস সালাম দুটি মু'জিযা প্রদর্শন করেছিলেন। একটি হল লাঠির সাপ হয়ে যাওয়া আর অপরটি হল হাত গলাবন্ধ কিংবা বগলের নীচে দাবিয়ে বের করে আনলে তার প্রদীপ্ত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠা। প্রথম মু'জিযাটি ছিল বিরোধীদেরকে ভীতি প্রদর্শন করার জন্য আর দ্বিতীয়টি তাদেরকে আকৃষ্ট করে আনার উদ্দেশ্যে। এতে ইঙ্গিত ছিল যে, মূসা আলাইহিস সালামের শিক্ষায় হেদায়াতের জ্যোতি রয়েছে আর সেটির অনুসরণ ছিল কল্যাণের কারণ।
চৌদ্দতম রুকূ’
[১] ملا শব্দটি ব্যবহৃত হয় কোনো সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী নেতৃবর্গকে বুঝানোর জন্য। অর্থ হচ্ছে, ফিরআউন সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এসব মু'জিযা দেখে তাদের সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বলল: এ যে বড় পারদর্শী জাদুকর। তার কারণ প্রত্যেকের চিন্তা তার নিজ যোগ্যতা অনুসারেই হয়ে থাকে। সে হতভাগারা আল্লাহর পরিপূর্ণ কুদরাত ও মহিমা সম্পর্কে কি বুঝবে, যারা জীবনভর ফিরআউনকে রব আর জাদুকরদেরকে নিজেদের পথপ্রদর্শক মনে করেছে এবং জাদুকরদের ভোজবাজীই দেখে এসেছে। কাজেই তারা এহেন বিস্ময়কর ঘটনা দেখার পর এছাড়া আর কিইবা বলতে পারত যে, এটা একটা মহাজাদু। কিন্তু তারাও এখানে ساحر এর সাথে عليم শব্দটি যোগ করে একথা প্রকাশ করে দিয়েছে যে, মূসা আলাইহিস সালামের মু'জিযা সম্পর্কে তাদের মনেও এ অনুভূতি জন্মেছিল যে, এ কাজটি সাধারণ জাদুকরদের কাজ থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন প্রকৃতির। এজন্যই স্বীকার করে নিয়েছে যে, তিনি বড়ই বিজ্ঞ জাদুকর।
বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা'আলা সর্বযুগেই নবী-রাসূলগণের মু'জিযাসমূহকে এমনি ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন যে, দর্শকবৃন্দ যদি সামান্যও চিন্তা করে আর হঠকারীতা অবলম্বন না করে তাহলে মু'জিযা ও জাদুর মাঝে যে পার্থক্য তা নিজেরাই বুঝতে পারে। জাদুকররা সাধারণতঃ অপবিত্রতা ও পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবে থাকে। পঙ্কিলতা ও অপবিত্রতা যত বেশী হবে তাদের জাদুও তত বেশী কার্যকর হবে। পক্ষান্তরে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা হল নবী-রাসূলগণের সহজাত অভ্যাস। তাছাড়া মু'জিযা সরাসরি আল্লাহ্ তা'আলার কুদরাতের কাজ। তাই কুরআনুল কারীমে এ বিষয়টিকে আল্লাহ্ তা'আলার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। যেমন (وَلٰكِنَّ اللّٰهَ رَمٰى) “এবং আল্লাহ তা'আলাই সে তীর নিক্ষেপ করেছিলেন।” [সূরা আল-আনফাল ১৭]
সারমর্ম এই যে, ফিরআউনের সম্প্রদায়ও মূসা আলাইহিস সালামের মু'জিযাকে নিজেদের জাদুকরদের কার্যকলাপ থেকে কিছুটা স্বতন্ত্রই মনে করেছিল। সেজন্যই একথা বলতে বাধ্য হয়েছিল যে, এ তো বড় বিজ্ঞ জাদুকর, সাধারণ জাদুকররা যে এমন কাজ দেখাতে পারে না।
[১] এ আয়াতগুলোতে মূসা ‘আলাইহিস সালামের অবশিষ্ট কাহিনীর উল্লেখ রয়েছে যে, ফির’আউন যখন মূসা আলাইহিস সালামের প্রকৃষ্ট মু'জিযা দেখল: লাঠি মাটিতে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তা সাপে পরিণত হয়ে গেল এবং আবার যখন সেটাকে হাতে ধরলেন, তখন পুনরায় তা লাঠি হয়ে গেল। আর হাতকে যখন গলাবন্ধের ভিতরে দাবিয়ে বের করলেন তখন তা প্রদীপ্ত হয়ে চকমক করতে লাগল। এ আসমানী নিদর্শনের যৌক্তিক দাবী ছিল মূসা আলাইহিস সালামের উপর ঈমান নিয়ে আসা। কিন্তু ভ্রান্তবাদীরা যেমন সত্যকে গোপন করার জন্য এবং তা থেকে ফিরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে বাস্তব ও সঠিক বিষয়ের উপর মিথ্যার শিরোনাম লাগিয়ে থাকে, ফিরআউন এবং তার সম্প্রদায়ের নেতারাও তাই করল। বলল: তিনি বড় বিজ্ঞ জাদুকর এবং তার উদ্দেশ্য হল তোমাদের দেশ দখল করে নিয়ে তোমাদেরকে বের করে দেয়া। কাজেই তোমরাই বল এখন কি করা উচিত?
[১] সম্প্রদায়ের লোকেরা পরামর্শ দিল যে, ইনি যদি জাদুকর হয়ে থাকেন এবং জাদুর দ্বারাই আমাদের দেশ দখল করতে চান, তবে তার মোকাবেলা করা আমাদের পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। আমাদের দেশেও বহু বড় বড় অভিজ্ঞ জাদুকর রয়েছে; যারা তাকে যাদুর দ্বারা পরাভূত করে দেবে। কাজেই কিছু সৈন্য-সামন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিন। তারা সব শহর থেকে জাদুকরদেরকে ডেকে নিয়ে আসবে। তখন জাদু মন্ত্রের বহুল প্রচলন ছিল এবং সাধারণ লোকদের উপর জাদুকরদের প্রচুর প্রভাব ছিল। আর মূসা আলাইহিস সালামকেও লাঠি এবং উজ্জ্বল হাতের মু'জিযা এজন্যই দেয়া হয়েছিল যাতে জাদুকরদের সাথে তার প্রতিদ্বন্দিতা হয় এবং মু'জিযার মোকাবেলায় জাদুর পরাজয় সবাই দেখে নিতে পারে। আল্লাহ্ তা'আলার রীতিও ছিল তাই। প্রত্যেক যুগের নবী-রাসূলকেই তিনি সে যুগের জনগণের কাছে বহুল প্রচলিত বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত মু'জিযা দান করেছেন। ঈসা আলাইহিস সালামের যামানায় চিকিৎসা বিজ্ঞান যেহেতু উৎকর্ষের চরম শিখরে ছিল, সেহেতু তাকে মু'জিযা দেয়া হয়েছিল জন্মান্ধকে দৃষ্টিসম্পন্ন করে দেয়া এবং কুষ্ঠরোগগ্রস্তকে সুস্থ করে তোলা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে আরবে অলংকার শাস্ত্র ও বাগীতার চরম উৎকর্ষতা সাধিত হয়েছিল। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে বড় মু'জিযা হল কুরআন, যার মোকাবেলায় গোটা আরব-আজম অসমর্থ হয়ে পড়ে।
[১] ফিরআউনের জাদুকররা প্রথমে এসেই মজুরী নিয়ে দরকষাকষি করতে শুরু করল। তার কারণ যারা ভ্রান্তবাদী পার্থিব লাভই হল তাদের মূখ্য। কাজেই যেকোনো কাজ করার পূর্বে তাদের সামনে থাকে বিনিময় কিংবা লাভের প্রশ্ন। অথচ নবী-রাসূলগণ এবং তাদের যারা নায়েব বা প্রতিনিধি তারা প্রতি পদক্ষেপে ঘোষণা করেন: “আমরা যে সত্যের বাণী তোমাদের মঙ্গলের জন্য তোমাদেরকে পৌঁছে দেই তার বিনিময়ে তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান কামনা করি না। বরং আমাদের প্রতিদানের দায়িত্ব শুধু আল্লাহর উপরই রয়েছে।” [সূরা আস-শু'আরা ১০৯, ১২৭, ১৪৫, ১৬৪, ১৮০] ফির'আউন তাদেরকে বলল: তোমরা পারিশ্রমিক চাইছ? আমি পারিশ্রমিক তো দেবই আর তার সঙ্গে সঙ্গে তোমাদেরকে শাহী দরবারের ঘনিষ্ঠদের অন্তর্ভুক্ত করে নেব।
[১] অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দিতার জন্য যখন মাঠে গিয়ে সবাই উপস্থিত, তখন জাদুকররা মূসা ‘আলাইহিস্ সালামকে বলল, হয় আপনি প্রথমে নিক্ষেপ করুন অথবা আমরা প্রথম নিক্ষেপ করি। সম্ভবত তারা নিজেদের নিশ্চয়তা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার জন্যই তা বলেছিল। উদ্দেশ্য যেন এই যে, এ ব্যাপারে আমাদের কোনো পরোয়াই নেই, যে ইচ্ছা প্রথমে তার কর্মকাণ্ড প্রদর্শন করুক। মূসা ‘আলাইহিস্ সালাম তাদের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে নিয়ে নিজের মু’জিযা সম্পর্কে আশ্বস্ততার দরুন প্রথম তাদেরকেই সুযোগ দিলেন। বললেন, “তোমরাই প্রথমে নিক্ষেপ কর।” কারণ, তাদের কর্মকাণ্ডের পর মু’জিযা বের হলে সেটা তাদের অন্তরে কঠোরভাবে রেখাপাত করতে বাধ্য হবে। [ইবন কাসীর; সা’দী]
[১] অর্থাৎ জাদুকররা যখন তাদের লাঠি ও দড়িগুলো মাটিতে নিক্ষেপ করল, তখন দর্শকদের নযরবন্দী করে দিয়ে তাদের উপর ভীতি সঞ্চারিত করে দিল এবং মহাজাদু দেখাল। এ আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় যে, তাদের জাদু ছিল এক প্রকার নযরবন্দী যাতে দর্শকদের মনে হতে লাগল যে, এই লাঠি আর দড়িগুলো সাপ হয়ে দৌড়াচ্ছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে সেগুলো ছিল তেমনি লাঠি ও দড়ি যা পূর্বে ছিল, সাপ হয়নি। এটা এক রকম সম্মোহনী, যার প্রভাব মানুষের কল্পনা ও দৃষ্টিকে ধাধিয়ে দেয়। [ইবন কাসীর] কিন্তু তাই বলে এ কথা প্রতীয়মান হয় না যে, জাদু এ প্রকারেই সীমাবদ্ধ। বরং জাদুর বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। প্রত্যেক প্রকার অনুসারে শরীআতে তার বিধানও ভিন্ন হয়ে থাকে।
[১] এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা জাদুকরদের বিপরীতে মূসা আলাইহিস সালামকে কিভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমি মূসাকে নির্দেশ দিলাম যে, আপনার লাঠিটি মাটিতে ফেলে দিন। তা মাটিতে পড়তেই সবচেয়ে বড় সাপ হয়ে সমস্ত সাপগুলোকে গিলে খেতে শুরু করল, যেগুলো জাদুকররা জাদুর দ্বারা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু মূসা আলাইহিস সালামের লাঠি যখন এক বিরাট আযদাহা বা অজগরের আকার ধারণ করে আসল তখন সে সবগুলোকে গিলে খেয়ে শেষ করে ফেলল।