[১] এটিই প্রত্যেক যুগের মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। মৌখিক স্বীকারোক্তি ও ইসলামের গণ্ডীর মধ্যে নামমাত্র প্রবেশের মাধ্যমে মুসলিম হিসাবে যতটুকু স্বার্থ ভোগ করা যায় তা তারা ভোগ করে। আবার অন্যদিকে কাফের হিসাবে যে স্বার্থটুকু ভোগ করা সম্ভব তা ভোগ করার জন্য তারা কাফেরদের সাথে যোগ দেয়। তাদেরকে বলে: আমরা মোটেই গোঁড়া বা প্রতিক্রিয়াশীল অথবা মৌলবাদী-বিদ্বেষপরায়ণ মুসলিম নই। মুসলিমদের সাথে আমাদের নামের সম্পর্ক আছে কিন্তু আমাদের মানসিক ঝোঁক, আগ্রহ ও বিশ্বস্ততা রয়েছে তোমাদের প্রতি। চিন্তা-ভাবনা, আচার-ব্যবহার, রুচি-প্রকৃতি ইত্যাদি সবদিক দিয়ে তোমাদের সাথে আমাদের গভীর মিল। তাছাড়া ইসলাম ও কুফরীর সংঘর্ষে আমরা তোমাদের পক্ষই অবলম্বন করব।
[২] এ আয়াতের অর্থ এ নয় যে, দুনিয়াতে কোনো কাফের ঈমানদারদের উপর বিজয়ী হবে না। কারণ, এটার মূলকথা আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত। আয়াতের শুরুতেই ‘কিয়ামতের দিন’ উল্লেখ করার মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট এক লোক এসে বলল যে, এ আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, “আল্লাহ কখনই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোনো পথ রাখবেন না” অথচ কাফেররা মুমিনদের উপর বিজয়ী হচ্ছে। তখন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আয়াতের প্রথমাংশের দিকে তাকাও। সেখানে বলা হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন’। সুতরাং কিয়ামতের দিন আল্লাহ কখনই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোনো পথ রাখবেন না। [মুস্তাদরাকে হাকিম ২/৩০৯; ধিয়া আল-মাকদেসী, আল-আহাদিসুল মুখতারাহ ২/৪০৬-৪০৭, হাদীস নং ৭৯৩]
তবে ইমামগণ এ আয়াত থেকে দুনিয়াতে এ মাস’আলা নিয়েছেন যে, কোনো কাফের কোনো মুমিনের ওয়ারিশ হয় না। [আত-তালিকুল মুমাজ্জাদ আলা মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ]
একুশতম রুকূ‘
[১] কাফেরদের ধোঁকার কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে ধোঁকায় ফেলা যুক্তিযুক্ত ও যথার্থ। এতে আল্লাহর জন্য খারাপ গুণ বিবেচিত হবে না। কারণ, এটি তাদের কর্মের বিপরীতে আল্লাহর কর্ম। অনুরূপ আলোচনা সূরা আল-বাকারার ৯ ও ১৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যাতেও বর্ণিত হয়েছে। তবে তাদেরকে কিভাবে আল্লাহ তা’আলা ধোঁকায় ফেলবেন, তার বর্ণনায় সুদ্দী ও হাসান বসরী বলেন, কিয়ামতের দিন তাদেরকে কিছু নূর বা আলো দেয়া হবে, ফলে তারা মুমিনদের সাথে চলতে থাকবে। যেমনিভাবে তারা দুনিয়াতে মুমিনদের সাথে ছিল। তারপর আল্লাহ্ তা’আলা তাদের সে নূর বা আলো ছিনিয়ে নিবেন। ফলে তাদের আলো নিষ্প্রভ হয়ে যাবে। তখন তারা অন্ধকারে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আর ঠিক তখনি তাদের ও মুমিনদের মধ্যে প্রাচীর পড়ে যাবে। পরস্পর পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] মূলতঃ এটি সূরা আল-হাদীদের ১৩ নং আয়াতের তাফসীরও বটে।
[২] আয়াতে মুনাফিকদের তিনটি খারাপ গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। এক. তারা তাদের সালাতে অলসতা করে। দুই. তারা সালাতে প্রদর্শনেচ্ছাসহকারে দাঁড়ায়। তিন. তারা খুব কমই আল্লাহর যিকর করে। পবিত্র কুরআনের অন্যান্য আয়াতেও তাদের এ বদ স্বভাবসমূহের কথা উল্লেখিত হয়েছে। যেমন, সূরা আত-তাওবাহ্ ৫৪; সূরা আল-মাউন ৪-৬।
তাছাড়া হাদীসেও মুনাফিকের এ সমস্ত চরিত্রের কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ঐটি হচ্ছে মুনাফিকের সালাত। সে সূর্যের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর যখন সূর্য শয়তানের দু শিংয়ের মাঝখানে পৌছে (অর্থাৎ ডুবার কাছাকাছি পৌছে) তখন সে উঠে চারবার ঠোকর লাগায়। যাতে আল্লাহর স্মরণ খুব কমই করে থাকে।” [মুসলিম ৬২২]
[১] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মুনাফিকের উদাহরণ হচ্ছে, ঐ ছাগীর ন্যায়, যে দুই পাঠা ছাগলের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। (প্রবৃত্তির তাড়নায়) কখনও এটার কাছে যায়, কখনও অপরটির কাছে যায়।” [মুসলিম ২৭৮৪] মুনাফিক নিজেকে মুশরিকও বলতে চায় না, আবার ঈমানদারও হতে চায় না। [তাবারী]
[১] এ আয়াতের তাফসীরে পূর্ববর্তী ১৩৯ নং আয়াতের তাফসীর ও সূরা আলে ইমরানের ২৮ নং আয়াতের তাফসীর দেখা যেতে পারে।
[১] এ আয়াতে মুনাফিকদের স্থান নির্দেশ করে বলা হয়েছে যে, তারা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। অন্য স্থানে ফিরআউন ও তার অনুসারীদের জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। “আগুন, তাদেরকে তাতে উপস্থিত করা হয় সকাল ও সন্ধ্যায় এবং যেদিন কিয়ামত ঘটবে সেদিন বলা হবে, ‘ফিরআউন গোষ্ঠীকে নিক্ষেপ কর কঠোর শাস্তিতে।” [সূরা গাফির: ৪৬]
আবার অন্যত্র বনী ইসরাইলের মধ্যে যাদেরকে আকাশ থেকে দস্তরখানসহ খাবার দেয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে যারা কুফরী করবে তাদের জন্য এমন শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে শাস্তি আল্লাহ আর কাউকে দিবেন না। “আল্লাহ বললেন, আমিই তোমাদের কাছে এটা পাঠাব; কিন্তু এর পর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরী করলে তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্বজগতের আর কাউকেও দেব না।” [সূরা আল-মায়িদাহ ১১৫]
সুতরাং এটাই বলা চলে যে, সবচেয়ে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে এ তিন শ্রেণীর লোক। [আদওয়াউল বায়ান] এ আয়াতে বর্ণিত ‘দারকুল আসফাল’ বা নিম্নতম স্তর কী এ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সেটা হবে বদ্ধ সিন্ধুক। [মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবাহ ১৩/১৫৪, নং ১৫৯৭২]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, দারকুল আসফাল হচ্ছে, এমন কিছু ঘর যেগুলোর দরজা বন্ধ করা আছে। আর সেগুলোকে উপর ও নিচ থেকে প্রজ্জলিত করা হবে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] ইবন আব্বাস বলেন, এর অর্থ, জাহান্নামের নীচে থাকবে। [তাবারী]
[১] কাতাদাহ বলেন, এখানে সংশোধন করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে নেয়া। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
[২] এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, আল্লাহ তা’আলার দরবারে একমাত্র ঐসব আমলই গৃহীত ও কবুল হয় যা শুধু তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে এবং কোনোরূপ রিয়া তথা লোক দেখানো ও শোনানোর লেশমাত্র উদ্দেশ্য যার মধ্যে নেই।
[১] আয়াতে শোকর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর আসল অর্থ হচ্ছে নেয়ামতের স্বীকৃতি দেয়া ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা এবং অনুগৃহীত হওয়া। এ ক্ষেত্রে আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ না হও এবং তাঁর সাথে নিমকহারামী না কর; বরং যথার্থই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ও শোকর আদায়কারী হও তাহলে আল্লাহ অনর্থক তোমাদের শাস্তি দেবেন না। মোটকথা, আল্লাহ তা’আলা ঈমানদার এবং শোকরগুজারকে শাস্তি দিবেন না। [তাবারী] কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অনুগ্রহকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সঠিক পদ্ধতি কী? বস্তুতঃ হৃদয়ের সমগ্র অনুভূতি দিয়ে তার অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেয়া, মুখে এ অনুভূতির স্বীকারোক্তি করা এবং কার্যকলাপের মাধ্যমে অনুগৃহীত হওয়ার প্রমাণ পেশ করাই হচ্ছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সঠিক উপায়। এ তিনটি কাজের সমবেত রূপই হচ্ছে শোকর। এ শোকরের দাবী হচ্ছে প্রথমতঃ অনুগ্রহকে অনুগ্রহকারীর অবদান বলে স্বীকার করা। অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে অনুগ্রহকারীর সাথে আর কাউকে অংশীদার না করা। দ্বিতীয়তঃ অনুগ্রহকারীর প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের অনুভূতি নিজের হৃদয়ে ভরপুর থাকা এবং অনুগ্রহকারীর বিরোধীদের প্রতি এ প্রসঙ্গে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা, আন্তরিকতা, আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার সম্পর্ক না থাকা। তৃতীয়তঃ অনুগ্রহকারীর আনুগত্য করা, তার হুকুম মেনে চলা, তার নেয়ামতগুলোকে তার মর্জির বাইরে ব্যবহার না করা।