[১] (اَمَانِيَّ) শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে মিথ্যা আশা। এ অর্থের পক্ষে অন্যান্য আয়াতও সাক্ষ্য দেয়। যেমন বলা হয়েছে, “আর তারা বলে, ‘ইয়াহুদী অথবা নাসারা ছাড়া অন্য কেউ কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ এটা তাদের মিথ্যা আশা।" [সূরা আল-বাকারাহ: ১১১]
আরও এসেছে, “তোমাদের আশা-আকাংখা ও কিতাবীদের আশা-আকাংখা অনুসারে কাজ হবে না।" [সূরা আন-নিসা: ১২৩] উপরোক্ত দুই আয়াতেও (اَمَانِيَّ) শব্দ মিথ্যা আশা-আকাংখা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে কোনো কোনো তাফসীরকার এর আরও একটি অর্থ করেছেন, তা হচ্ছে পড়া-লেখা না জানা। অর্থাৎ ইয়াহুদীদের মধ্যে এক গোষ্ঠী আছে যারা কোনো পড়া-লেখা জানে না। তাদের কাজ হলো অন্যের অন্ধ অনুসরণ করা। কিন্তু বাক্যের প্রথমে (اُمِّيُّوْنَ) শব্দের উল্লেখ থাকায় এ অর্থটি খুব বেশী উপযুক্ত নয়। [আদওয়াউল বায়ান]
[২] লক্ষণীয় যে, আল্লাহ্ তা'আলা ৭৫-৭৮ আয়াতসমূহে ইয়াহুদীদের তিন শ্রেণীর লোকের উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হচ্ছে আলেম সম্প্রদায়, তাদের কাজ হলো আল্লাহ্র কালাম বিকৃত করা। আরেক দল হচ্ছে মুনাফিক, তারা মুমিনদের কাছে নিজেদেরকে মুমিন হিসেবে পেশ করে। আরেক শ্রেণী হচ্ছে জাহেল মূৰ্খ গোষ্ঠী, তারা পড়া-লেখা জানে না। তারা কেবল অন্যদের অন্ধ অনুসরণ করে থাকে। [ইবন কাসীর]
[১] (وَيْلٌ) শব্দটি পবিত্র কুরআনে এখানেই প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে। ওপরে এর অর্থ করা হয়েছে দূর্ভোগ। এছাড়া এর এক তাফসীর আতা ইবন ইয়াসার থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘এটি জাহান্নামের একটি উপত্যকার নাম, যদি পাহাড়ও এতে নিয়ে ফেলা হয় তবে তার তাপে তাও মিইয়ে যাবে’। [ইবনুল মুবারকের আয-যুহদ, নং ৩৩২]
আবু আইয়াদ আমর ইবন আসওয়াদ আল-আনাসী বলেন, (وَيْلٌ) হচ্ছে, জাহান্নামের মূল অংশ থেকে যে পুঁজ বয়ে যাবে তার নাম। [তাবারী] মোটকথা, সব রকমের শাস্তি ও ধবংস তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
[২] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “তোমরা কোনো ব্যাপারে কিতাবীদেরকে কেন জিজ্ঞেস কর? অথচ তোমাদের কাছে রয়েছে তোমাদের রাসূলের কাছে নাযিলকৃত আল্লাহ্র কিতাব যা সবচেয়ে আধুনিক, (আল্লাহ্র কাছ থেকে আসার ব্যাপারে) নবীন। তোমরা সেটা পড়ছ। আর সে কিতাবে আল্লাহ্ জানিয়েছেন যে, কিতাবীরা তাদের কিতাবকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেছে। তারা সামান্য অর্থের বিনিময়ে স্বহস্তে সে কিতাব লিপিবদ্ধ করে বলেছে যে, এটা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। তোমাদের কাছে এ সমস্ত জ্ঞান আসার পরও তা তোমাদেরকে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করা থেকে নিষেধ করছে না। না, আল্লাহ্র শপথ! তাদের একজনকেও দেখিনি যে, সে তোমাদেরকে তোমাদের কাছে কী নাযিল হয়েছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে।” [বুখারী ৭৩৬৩] সুতরাং আমাদের দীনের ব্যাপারে কোনো কিছুতেই ইয়াহুদী-নাসারাদের কোনো বর্ণনার প্রয়োজন আমাদের নেই ।
[১] আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল ! আল্লাহ্র কাছে কোন আমল সবচেয়ে উত্তম? তিনি বললেন, “সময়মত সালাত আদায় করা।” বললেন, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, “পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার" বললেন, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, “আল্লাহ্র পথে জিহাদ করা।” [বুখারী ৫২৭, মুসলিম ৮৫]
[২] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মিসকীন সে নয়, যে এক খাবার বা দুই খাবারের জন্য ঘুরে বেড়ায় বরং মিসকীন হচ্ছে, যার সামর্থ নেই অথচ সে লজ্জায় কারও কাছে চায় না। অথবা মানুষকে আগলে ধরে কোনো কিছু চায় না।” [বুখারী ১৪৭৬, মুসলিম ১০৩৯]
[৩] আয়াতে এমন কথাকে বুঝানো হয়েছে, যা সৌন্দর্যমণ্ডিত। এর অর্থ এই যে, যখন মানুষের সাথে কথা বলবে, নম্রভাবে হাসিমুখে ও খোলামনে বলবে। তবে দীনের ব্যাপারে শৈথিল্য অথবা কারো মনোরঞ্জনের জন্য সত্য গোপন করবে না। কারণ, আল্লাহ্ তা'আলা যখন মূসা ও হারূন ‘আলাইহিমাস সালামকে নবুয়ত দান করে ফি’রআউনের প্রতি পাঠিয়েছিলেন, তখন এ নির্দেশ দিয়েছিলেন, “ তোমরা উভয়েই ফির’আউনকে নরম কথা বলবে। " [সূরা ত্বা-হা: ৪৪]
আজ যারা অন্যের সাথে কথা বলে, তারা মূসা ‘আলাইহিস সালামের চাইতে উত্তম নয় এবং যার সাথে কথা বলে, সেও ফিরআউন অপেক্ষা বেশী মন্দ বা পাপিষ্ঠ নয়। সুতরাং সবার সাথে সুন্দরভাবে কথা বলা উচিত। হাদীসে এসেছে, “তোমরা সৎকাজের সামান্যতম কিছুকে খাটো করে দেখ না। যদিও তা হয় তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাত করা। " [মুসলিম ২৬২৬] তাছাড়া মানুষের সাথে সদালাপের অর্থ আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস থেকে এক বর্ণনায় এসেছে যে, তা হচ্ছে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
[৪] ‘অল্প কয়েকজন’ অর্থ, তারাই যারা তাওরাতের পুরোপুরি অনুসরণ করত, তাওরাত রহিত হওয়ার পূর্বে তারা মূসা ‘আলাইহিস সালাম প্রবর্তিত শরীআতের অনুসারী ছিল এবং তাওরাত রহিত হওয়ার পর ইসলামী শরীআতের অনুসারী হয়ে যায়। আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, একত্ববাদে ঈমান, এবং পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজন, ইয়াতীম বালক-বালিকা ও দীন-দরিদ্রের সেবাযত্ন করা, মানুষের সাথে নম্রভাবে কথাবার্তা বলা, সালাত আদায় করা ও যাকাত দেয়া ইসলামী শরীআতসহ পূর্ববর্তী শরী‘আতসমূহেও ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মানুষ সেগুলো ত্যাগ করে।