অষ্টম রুকূ‘
[১] আল্লামা শানকীতী বলেন, বিভিন্ন আয়াত থেকে এটাই বুঝা যায় যে, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটি ঐ সময়ই হবে, যখন ব্যক্তির সেখানে ইচ্ছা বা এখতিয়ার থাকবে। কিন্তু যখন ভয়-ভীতি বা সমস্যা থাকবে, তখন তাদের সাথে বাহ্যিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি ইসলাম শর্তসাপেক্ষে দিয়েছে। তা হচ্ছে, যতটুকু করলে তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রেও আন্তরিক বন্ধুত্ব থাকতে পারবে না। [আদওয়াউল বায়ান]
[১] মুজাহিদ বলেন, এখানে যাদের অন্তরে অসুখ রয়েছে বলে মুনাফিকদেরকে বোঝানো হয়েছে। তারা ইয়াহুদীদের সাথে গোপন শলা-পরামর্শ ও তাদের খাতির করে কথা বলতে সাচ্ছন্দ বোধ করে। অনুরূপভাবে তারা তাদের সন্তানদের দুধ পান করাতেও অভ্যস্ত। এ অবস্থায় তাদের আন্তরিক সম্পর্ক ইয়াহুদীদের সাথেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তারা সবসময় ভাবে যে, ইয়াহুদীদেরই বিজয় হবে। আর তখন তাদের কাছ থেকে তারা বাড়তি সুবিধা পাবে। [তাবারী]
[২] মুসলিমরা সে বিজয় দেখেছিল। সুদ্দী বলেন, সে বিজয় হচ্ছে, মক্কা বিজয়। [তাবারী] কাতাদা বলেন, এখানে বিজয় বলে আল্লাহর ফয়সালা বুঝানো হয়েছে। [তাবারী] কাতাদা আরও বলেন, মুনাফিকরা তখন ইয়াহুদীদের সাথে তাদের যে গোপন আঁতাত, ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, তাদের বিরুদ্ধাচারণ এবং এতদসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপের জন্য লজ্জিত হবে । [তাবারী]
[১] এ আয়াতে বিষয়টি আরো পরিস্কার করে বলা হয়েছে যে, যখন মুনাফেকদের মুখোশ উন্মোচিত হবে এবং তাদের বন্ধুত্বের দাবী ও শপথের স্বরূপ ফুটে উঠবে, তখন মুসলিমরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলবে, এরাই কি আমাদের সাথে আল্লাহর নামে কঠোর শপথ করে বন্ধুত্বের দাবী করত? আজ এদের সব লোক দেখানো ধর্মীয় কার্যকলাপই বিনষ্ট হয়ে গেছে। আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ তা’আলা যে অবস্থার কথা বর্ণনা করেছে, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই প্রত্যেক মুমিন-মুসলিম সবাই তার বাস্তব চিত্র প্রত্যক্ষ করেছিল। [সা’দী] আল্লামা শানকীতী বলেন, মুনাফিকদের মিথ্যা শপথের মূল কারণ হচ্ছে, তারা প্রচন্ড ভীতুপ্রকৃতির মানুষ ছিল। যদি কোথাও পালাবার পথ তাদের জানা থাকত তবে তারা সেটাই করত। [আদওয়াউল বায়ান]
[১] আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এ আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠোর হুশিয়ারী দেয়া হচ্ছে যে, যারাই আল্লাহর পথ ও তাঁর দীন থেকে পিছু ফিরে যাবে, তারা আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ্ তাআলা তার দীনের জন্য নতুন কোনো জাতিকে এগিয়ে আনবেন। [তাবারী] আইয়াদ আল আশ’আরী বলেন, যখন এ আয়াত নাযিল হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে আবু মূসা, এরা হল তোমার সম্প্রদায়। আর রাসূল হাত দিয়ে ইশারা করছিলেন আবু মূসা আল-আশ’আরীর দিকে। [মুস্তাদরাকে হাকেম ২/৩১৩]
[২] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে ভাষণ দিতে দাড়িয়ে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কারো হক জানা থাকলে সে যেন তা বলতে কাউকে ভয় না করে।’ বর্ণনাকারী আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এ হাদীস বর্ণনা করে কেঁদে ফেললেন। তারপর বললেন, আল্লাহর শপথ আমরা অনেক বিষয় দেখেছি, কিন্তু ভয় করেছি। [ইবন মাজাহ ৪০০৭, তিরমিযী ২১৯১]
[৩] এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, মুসলিমদের স্বার্থেই তাদেরকে অমুসলিমদের সাথে গভীর বন্ধুত্ব ও মেলামেশা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, সত্যদীন ইসলামের হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই গ্রহণ করেছেন। কোনো ব্যক্তি কিংবা দলের বক্রতা ও অবাধ্যতা দূরের কথা, স্বয়ং মুসলিমদের কোনো ব্যক্তি কিংবা দল যদি সত্যি সত্যিই ইসলাম ত্যাগ করে বসে এবং সম্পূর্ণ দীনত্যাগী হয়ে অমুসলিমদের সাথে হাত মিলায়, তবে এতেও ইসলামের কোনো ক্ষতি হবে না- হতে পারে না। মুসলিমরাও যদি দীনত্যাগী হয়ে যায়, আল্লাহ তা'আলা তাদের জায়গায় অন্য কোনো জাতির অভ্যুথান ঘটাবেন। সে জাতির মধ্যে বেশ কিছু গুণ থাকবে। তাদের প্রথম গুণ হচ্ছে যে, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তারা নিজেরাও আল্লাহ তা’আলাকে ভালোবাসবে। এ গুণটি দু’টি অংশে বিভক্ত- এক. আল্লাহর সাথে তাদের ভালোবাসা। একে কোনো না কোনো স্তরে মানুষের ইচ্ছাধীন মনে করা যায়। দুই. আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে ভালোবাসা। এতে বাহ্যতঃ মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের কোনো ভূমিকা নেই। যে বিষয়টি মানুষের ইচ্ছা ও সামর্থ্যের বাইরে, তা মানুষকে শুনানোরও কোনো বাহ্যিক সার্থকতা নেই। কিন্তু কুরআনুল কারীমের অন্যান্য আয়াতের পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, এ ভালোবাসার উপায়-উপকরণগুলোও মানুষের ইচ্ছাধীন। মানুষ যদি এসব উপায়কে কাজে লাগায়, তবে তাদের সাথে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে রাসূল, আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। এর ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে ভালোবাসতে থাকবেন, আর আল্লাহ তোমাদের অপরাধসমূহ মার্জনা করে দিবেন এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।” [সূরা আলে-ইমরান ৩১]
এ আয়াত থেকে জানা যাচ্ছে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার ভালোবাসা লাভ করতে চায়, তার উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত অনুসরণে অবিচল থাকা। এমনটা করলে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে ভালোবাসবেন বলে ওয়াদা দিয়েছেন। তাদের দ্বিতীয় গুণ হচ্ছে যে, তারা মুসলিমদের সামনে নম্র হবে এবং কোনো ব্যাপারে মতবিরোধ হলে সত্যপন্থী হওয়া সত্বেও সহজে বশ হয়ে তারা ঝগড়া ত্যাগ করবে। এ অর্থেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি ঐ ব্যক্তিকে জান্নাতের মধ্যস্থলে বাসস্থান দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করছি, যে সত্যপন্থী হওয়া সত্বেও ঝগড়া ত্যাগ করে। [আবু দাউদ ৪৮০০]
মোটকথা, তারা মুসলিমদের সাথে স্বীয় অধিকার কাজ-কারবারের ব্যাপারে কোনোরূপ ঝগ-ড়াবিবাদ রাখবে না। তাদের তৃতীয় গুণ হচ্ছে যে, তারা কাফেরদের উপর প্রবল, শক্তিশালী ও কঠোর। উদ্দেশ্য এই যে, তারা আল্লাহ ও তার দীনের শক্রদের মোকাবেলায় কঠোর ও পরাক্রান্ত। শক্ররা তাদেরকে সহজে কাবু করতে পারে না। উভয় বাক্য একত্রিত করলে সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, তারা হবে এমন এক জাতি, যাদের ভালোবাসা ও শক্রতা নিজ সত্ত্বা ও সত্ত্বাগত অধিকারের পরিবর্তে শুধু আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর দীনের খাতিরে নিবেদিত হবে। এ একই বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন,
( أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ)
-অর্থাৎ “কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।” [সূরা আল-ফাত্হ ২৯] তাদের চতুর্থ গুণ হচ্ছে, “তারা সত্য দীনের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে জিহাদে প্রবৃত্ত হবে।” এর সারমর্ম এই যে, কুফর ও দীনত্যাগের মোকাবেলা করার জন্য শুধু কতিপয় প্রচলিত ইবাদাত এবং নম্র ও কঠোর হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দীপনাও থাকতে হবে। এই উদ্দীপনাকে পূর্ণতা দানের জন্য পঞ্চম গুণ বলা হয়েছে, “দীনকে প্রতিষ্ঠিত ও সমুন্নত করার চেষ্টায় তারা কোনো ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনারই পরোয়া করবে না।” [ইবন কাসীর থেকে সংক্ষেপিত]
[১] এ আয়াতে মুসলিমদের গভীর বন্ধুত্ব ও বিশেষ বন্ধুত্ব যাদের সাথে হতে পারে, তাদের গুণাবলি বর্ণনা করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, প্রথমতঃ তারা পূর্ণ আদব ও শর্তাদিসহ নিয়মিত সালাত আদায় করে। দ্বিতীয়তঃ স্বীয় অর্থ-সম্পদ থেকে যাকাত প্রদান করে। তৃতীয়তঃ তারা বিনম্র ও বিনয়ী; স্বীয় সৎকর্মের জন্য গর্বিত নয়, তারা মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করে। [সা’দী]
[২] ফাইরোয আদ-দাইলামী বলেন, তার সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাদের প্রতিনিধি পাঠালেন। তারা এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো ঈমান এনেছি, এখন আমার বন্ধু-অভিভাবক কে? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল। তারা বলল: আমাদের জন্য এটাই যথেষ্ট এবং আমরা সন্তুষ্ট। [মুসনাদে আহমাদ ৪/২৩২]
[৩] আয়াতে উল্লেখিত (وَهُمْ رٰكِعُوْنَ) এ ركوع শব্দের কয়েকটি অর্থ হতে পারে। কোনো কোনো তাফসীরবিদ বলেন, এখানে ‘রুকূ’ অর্থ পারিভাষিক ‘রুকূ’, যা সালাতের একটি রুকন। অর্থাৎ আর তারা রুকুকারী। [ফাতহুল কাদীর] এটা যেমন ফরয সালাতের সাধারণ রুকু উদ্দেশ্য হতে পারে, তেমনিভাবে নফল সালাত আদায়কারী অর্থেও হতে পারে। [বাগভী, জালালাইন] পক্ষান্তরে অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, এখানে রুকু বলে বিনম্র ও খুশু-খুযু সম্পন্ন হওয়া বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর, সা’দী] প্রথম অর্থের ক্ষেত্রে واو টি عطف এর জন্য। আর দ্বিতীয় অর্থের ক্ষেত্রে واو টি حال বা অবস্থা নির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইবন কাসীর এ অর্থটি গৌণ বিবেচনা করেছেন।
[১] আয়াতে বলা হয়েছে, যারা কুরআনের নির্দেশ পালন করে বিজাতির সাথে গভীর বন্ধুত্ব করা থেকে বিরত থাকে এবং শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা হবে বিজয়ী ও বিশ্বজয়ী। বলা হয়েছে, যেসব মুসলিম আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ পালন করে, তারা আল্লাহর দল। এরপর সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, পরিণামে আল্লাহর দলই সবার উপর জয়ী হবে। পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে সবাই প্রত্যক্ষ করে নিয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরাম সবার উপর জয়ী হয়েছেন। এটি মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বড় সুসংবাদ। যারা আল্লাহর নির্দেশ মানবে, তারা তার দল ও বাহিনীভুক্ত হবে। তাদের জন্যই জয় অপেক্ষা করছে। যদিও মাঝে মাঝে তাদের উপর কোনো কোনো বিপদ আসে, তা শুধুমাত্র আল্লাহ তাঁর কোনো ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার জন্য তা করিয়ে থাকেন। তবে শেষ পর্যন্ত শুভ পরিণাম ও বিজয় তাদেরই পক্ষে যায়। অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা অনুরূপ বলেছেন, তিনি বলেছেন, “আর আমাদের বাহিনী অবশ্যই বিজয়ী হবে।” [সূরা আস-সাফফাত ১৭৩] [সা’দী]
নবম রুকূ‘
[১] অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ, তোমরা তাদেরকে সাখী অথবা ঘনিষ্ঠ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যারা তোমাদের দীনকে উপহাস ও খেলা মনে করে। এরা দুই দলে বিভক্ত এক. আহ্লে কিতাব সম্প্রদায়। দুই. মুশরিক সম্প্রদায়। আয়াতে বলা হচ্ছে যে, তোমাদের কাছে যে ঈমান আছে তার চাহিদা হচ্ছে, তোমরা তাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাবে না। তাদের কাছে গোপন ভেদ প্রকাশ করবে না। তাদের সাথে বৈরীভাব রাখবে। তোমাদের কাছে যে তাকওয়া আছে তাও তোমাদেরকে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করে। [সা’দী]