[১] তাদেরকে ইয়াহুদী নামকরণ তারা নিজেরাই করেছিল। কারও কারও মতে ইয়াকুব ‘আলাইহিস সালামের পুত্র ‘ইয়াহুদ’ এর নামানুসারে তাদের এ নাম দেয়া হয়েছিল। অপর কারও কারও মতে, ‘হাওদ’ শব্দের অর্থ ঝুঁকে যাওয়া। তারা তাওরাত পাঠের সময় সামনে-পিছনে ঝুঁকে যেত বলে তাদের এ নাম হয়েছে। অথবা ‘হাওদ' এর অর্থ ফিরে আসা। তারা বলেছিল (اِنَّا هُدْنَآ اِلَيْكَ) “আমরা তোমার প্রতি প্রত্যাবর্তন করলাম।” [সূরা আল-আরাফ: ১৫৬]
সে অনুসারে তাদের নাম হয়েছে, ইয়াহুদ। পবিত্র কুরআনে যেখানেই তাদেরকে এ নামে উল্লেখ করা হয়েছে সেখানেই তাদের খারাপ গুণে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ইয়াহুদী নামটি কোনো ভাল গুণবাচক নাম নয়।
[২] কাতাদাহ বলেন, তাদেরকে নাসারা নামকরণ করা হয়েছে, কেননা তারা ‘নাসেরাহ’ নামক এক গ্রামের অধিবাসী ছিল যেখানে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম তাদের কাছে এসেছিলেন। এ নামে তারা নিজেদেরকে নামকরণ করেছিল। তাদেরকে এ নাম দেয়ার জন্য আল্লাহ্ নির্দেশ দেন নি।
[আত-তাফসীরুস সহীহ]
[৩] সাবেঈন কারা এ নিয়ে মুফাসসিরগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তারা ইয়াহুদী-নাসারা এবং অগ্নি-উপাসকদের মাঝামাঝি একটি জাতি। তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট দ্বীন নেই। হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তারা ফেরেশতা-উপাসক জাতি। তারা কেবলার দিকে ফিরে সালাত আদায় করে। রাগেব ইস্পাহানী বলেন, তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা নূহ ‘আলাইহিস সালামের দীনের অনুসরণ করে চলত। বস্তুতঃ সাবেঈনরা এক বিরাট জাতি, যাদের অস্তিত্ব ইরাক থেকে শুরু করে পূর্ব দিকের দেশগুলোতে দেখা যায়। বর্তমানেও ইরাকে তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তাদের কিছু ‘ইবাদাত, যেমন অযু, সালাত, কেবলা, সাওম ইত্যাদি প্রায় মুসলিমদের মতই। কিন্তু, আকীদাগতভাবে তারা দু’ভাগে বিভক্ত।
(এক) যারা একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত করে। কিন্তু তারা কোনো রাসূলের অনুসরণ করে না।
(দুই) যারা তারকা-পূজারী এবং পৃথিবীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরাসরি তারকার প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করে।
[৪] এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেন যে, আমার দরবারে কোনো ব্যক্তির বিশেষ মর্যাদা নেই। যে ব্যক্তি ঈমান ও কর্মে পুরোপুরি আনুগত্য স্বীকার করবে, সে পূর্বে যেমনই থাকুক না কেন, আমার নিকট গ্রহণযোগ্য এবং তার আমল পছন্দনীয় ও প্রশংসনীয় আর এটাও সুস্পষ্ট যে, কুরআন নাযিল হওয়ার পর ‘পূর্ণ আনুগত্য’ মুহাম্মাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মুসলিম হওয়াতেই সীমাবদ্ধ। আয়াতে (وَعَمِلَ صَالِحًا) বা “সৎকাজ করে” এটুকু বলার মাধ্যমে একমাত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করার দ্বারাই তাদের নাজাত পাওয়া সীমাবদ্ধ এটা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কারণ, যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ না করা হয়, তবে কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যার অর্থ এই যে, যে মুসলিম হবে, সে-ই আখেরাতে নাজাতের অধিকারী হবে। অর্থাৎ পূর্বোল্লিখিত ইয়াহুদী, নাসারা, সাবেয়ী, মাজুস এ সমস্ত লোকদের এতসব অনাচার ও গৰ্হিত আচরণের পরও কেউ যদি মুসলিম হয়ে যায়, তবে আমি সব মাফ করে দেব।
[১] আবুল আলীয়াহ বলেন, এ অঙ্গীকার ছিল, নিষ্ঠাসহকারে একমাত্র আল্লাহ্ ইবাদত করা। আর কারও ইবাদত না করা। [আত-তাফসীরুস সহীহ] তবে অন্যান্য তাফসীরকারগণ বলেন, এর সাথে সাথে অঙ্গীকারের অন্যান্য বিষয়াবলী আয়াতের শেষেই বর্ণিত হয়েছে।
[২] আয়াতে বর্ণিত (بِقُوَّةٍ) এর তাফসীর কেউ করেছেন, দৃঢ়তার সাথে। কাতাদাহ করেছেন, গুরুত্বের সাথে। আবুল আলীয়াহ বলেছেন, আনুগত্যের সাথে। আর মুজাহিদ বলেছেন, এর উপর আমল করার স্বীকারোক্তির সাথে। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
[৩] যখন মূসা ‘আলাইহিস সালামকে তুর পর্বতে তাওরাত প্রদান করা হল, তখন তিনি ফিরে এসে তা ইসরাঈল-বংশধরকে দেখাতে ও শোনাতে আরম্ভ করলেন। এতে হুকুমগুলো কিছুটা কঠোর ছিল, কিন্তু তাদের অবস্থানুযায়ীই ছিল। এ সম্পর্কে প্রথম তারা এ কথাই বলেছিল যে, যখন স্বয়ং আল্লাহ্ তা'আলা আমাদেরকে বলে দেবেন যে, ‘এটা আমার কিতাব' তখনই আমরা মেনে নেবো। (যে বর্ণনা উপরে চলে গেছে) মোটকথা যে সত্তরজন লোক মূসা ‘আলাইহিস সালামের সাথে গিয়েছিল, তারাও ফিরে এসে সাক্ষী দিল। কিন্তু ইসরাঈল-বংশধররা পরিষ্কারভাবে বলে দিল, আমাদের দ্বারা এ গ্রন্থের উপর আমল করা সম্ভব হবে না। ফলে আল্লাহ্ তাআলা ফেরেশতাদেরকে হুকুম করলেন, ‘তুর পর্বতের একটি অংশ তুলে নিয়ে তাদের মাথার উপর ঝুলিয়ে দাও এবং বল, হয় কিতাব মেনে নাও, নইলে এক্ষুণি মাথার উপর পড়লো। অবশেষে নিরুপায় হয়ে তা মেনে নিতে হলো। এ আয়াতে বর্ণিত ‘তুর পাহাড় উঠানোর’ তাফসীর আল্লাহ্ তা'আলা অন্য আয়াতে করে দিয়েছেন। যেখানে বলা হয়েছে, “স্মরণ করুন, আমরা পর্বতকে তাদের উপরে উঠাই, আর তা ছিল যেন এক শামিয়ানা। তারা মনে করল যে, ওটা তাদের উপর পড়ে যাবে। বললাম, ‘আমি যা দিলাম তা দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং ওটাতে যা আছে তা স্মরণ কর।” [সূরা আল-আ'রাফ: ১৭১]
[১] এ আয়াতের সম্বোধন বাহ্যিক দৃষ্টিতে সে সমস্ত ইয়াহুদীদের করা হচ্ছে, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে উপস্থিত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান না আনাও যেহেতু উল্লিখিত প্রতিজ্ঞা ভংগেরই অন্তর্ভুক্ত, সেহেতু তাদেরকে পূর্বোক্ত প্রতিজ্ঞা ভংগকারীদের আওতাভুক্ত করে উদাহরণস্বরূপ বলা হয়েছে যে, এরপরও আমি দুনিয়াতে তোমাদের উপর তেমন কোনো আযাব নাযিল করিনি, যেমনটি পূর্বকালে প্রতিজ্ঞা ভংগকারীদের উপর নাযিল হয়ে থাকত। এটা একান্তই আল্লাহ্র রহমত।
[১] আয়াতে বর্ণিত এ ঘটনাটি দাউদ ‘আলাইহিস সালামের আমলেই সংঘটিত হয়। ইসরাঈল-বংশধরদের জন্য শনিবার ছিল পবিত্র এবং সাপ্তাহিক উপাসনার জন্য নির্ধারিত দিন। এ দিন মৎস শিকার নিষিদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রোপকূলের অধিবাসী ছিল বলে মৎস শিকার ছিল তাদের প্রিয় কাজ। তারা প্রথম প্রথম কলা-কৌশলের অন্তরালে এবং পরে সাধারণ পদ্ধতিতে ব্যাপকভাবে মৎস শিকার করতে থাকে। এতে তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল ছিল সৎ ও বিজ্ঞ লোকদের। তারা এ অপকর্মে বাধা দিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ বিরত হলো না। অবশেষে তারা এদের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে পৃথক হয়ে গেলেন। এমনকি বাসস্থানও দুই ভাগে ভাগ করে নিলেন। একভাগে অবাধ্যরা বসবাস করতো আর অপর ভাগে সৎ ও বিজ্ঞজনেরা বাস করতেন। একদিন তারা অবাধ্যদের বস্তিতে অস্বাভাবিক নীরবতা লক্ষ্য করলেন। অতঃপর সেখানে পৌছে দেখলেন যে, সবাই বিকৃত হয়ে বানরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কাতাদাহ বলেন, তাদের যুবকরা বানরে এবং বৃদ্ধরা শুকরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। রূপান্তরিত বানররা নিজ নিজ আত্মীয় স্বজনকে চিনতো এবং তাদের কাছে এসে অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করতো। হাদীসে এসেছে, জনৈক সাহাবী একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের যুগের বানর ও শুকরগুলো কি সেই রূপান্তরিত ইয়াহুদী সম্প্রদায়? তিনি বললেন, "আল্লাহ্ তা'আলা যখন কোনো সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেন অথবা তাদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকেন তখন তিনি তাদের অবশিষ্ট বংশধর রাখেন না। বস্তুতঃ বানর ও শূকর পৃথিবীতে তাদের পূর্বেও ছিল। [মুসলিম ২৬৬৩] সুতরাং বর্তমান বানরদের সাথে রূপান্তরিত বানর ও শূকরের কোনো সম্পর্ক নেই। [দেখুন, আত-তাফসীরুস সহীহ] যেমনিভাবে এ ধারণা করারও কোনো সুযোগ নেই যে, মানুষ কোনো এক সময় বানরের বংশধর ছিল।
[১] এ তাফসীর আবুল আলীয়াহ থেকে বর্ণিত। পক্ষান্তরে মুজাহিদ এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, এর অর্থ আমরা এটাকে তাদের এ ঘটনার পূর্বের গুনাহ এবং এ ঘটনার গোনাহের জন্য শাস্তি হিসেবে নির্ধারণ করে দিলাম। [আত-তাফসীরুস সহীহ] অর্থাৎ আল্লাহ্ তাদের শাস্তি দুনিয়াতেই দিয়ে দিলেন।
[২] এ ঘটনা মুত্তাকীদের জন্য উপদেশস্বরূপ কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “ইয়াহুদীরা যে অন্যায় করেছে তোমরা তা করতে যেও না। এতে তোমরা ইয়াহুদীদের মত আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন তা বাহানা করে হালাল করে ফেলবে। ” [ইবন বাত্তাহ, ইবতালুল হিয়াল: ৪৬, ৪৭]
[১] এ ঘটনার সংক্ষিপ্তবিবরণ এই যে, ইসরাঈল-বংশধরদের মধ্যে একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। হত্যাকারী কে? তা জানা কঠিন হয়ে দাড়ায়। তখন, আল্লাহ্ তাদেরকে একটি গরু জবাই করতে নির্দেশ দেন। ইসরাঈল-বংশধররা কোনো বাদানুবাদে প্রবৃত্ত না হলে এতসব শর্তও আরোপিত হতো না, বরং যেকোনো গরু জবাই করলেই তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারতো। কিন্তু তারা প্রশ্ন করে বিভিন্ন শর্তারোপ করে নেয়। শেষ পর্যন্ত তারা সেটা করতে সমর্থ হয়। তারপর গরু জবাই করার পর মৃতদেহে সে গরুর গোশতের টুকরো স্পর্শ করাতেই সে জীবিত হয়ে যায় এবং হত্যাকারীর নাম বলে তৎক্ষণাৎ আবার মারা যায়। [ইবন কাসীর থেকে সংক্ষেপিত]