[১] বরকতের শাব্দিক অর্থ প্রবৃদ্ধি। আর বরকতের মূল হচ্ছে, কোনো কিছু নিয়মিত থাকা। [বাগভী] আসমান ও যমীনের সমস্ত বরকত খুলে দেয়া' বলতে উদ্দেশ্য হল সব রকম কল্যাণ সবদিক থেকে খুলে দেয়া। অর্থাৎ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক সময়ে আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হত, আর যমীন থেকে যে কোনো বস্তু তাদের মনমত উৎপাদিত হত, অতঃপর সেসব বস্তু দ্বারা তাদের লাভবান হওয়ার এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে দেয়া হত। [ফিাতহুল কাদীর] তাতে তাদেরকে এমন কোনো চিন্তা-ভাবনা কিংবা টানাপোড়নের সম্মুখীন হতে হত না যার দরুন বড় বড় নেয়ামতও পঙ্কিলতাপূর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে তাদের প্রতিটি বিষয়ে বরকত বা প্রবৃদ্ধি ঘটত।
পৃথিবীতে বরকতের বিকাশ ঘটে দু'রকমে। কখনো মুল বস্তুটি প্রকৃতভাবেই বেড়ে যায়। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মু'জিযাসমূহের মধ্যে রয়েছে একটা সাধারণ পাত্রের পানি দ্বারা গোটা কাফেলার পরিতৃপ্ত হওয়া, কিংবা সামান্য খাদ্য দ্রব্যে বিরাট সমাবেশের পেটভরে খাওয়া যা সঠিক ও বিশুদ্ধ রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে। আবার কোনো কোনো সময় মূল বস্তুতে বাহ্যতঃ কোনো বরকত বা প্রবৃদ্ধি যদিও হয় না, পরিমাণে যা ছিল তাই থেকে যায় কিন্তু তার দ্বারা এতবেশী কাজ হয় যা এমন দ্বিগুণ, চতুগুণ বস্তুর দ্বারাও সাধারণতঃ সম্ভব হয় না। তাছাড়া সাধারণভাবেও দেখা যায় যে, কোনো একটা পাত্র কাপড়-চোপড় কিংবা ঘরদুয়ার অথবা ঘরের অন্য কোনো আসবাবপত্র এমন বরকতময় হয় যে মানুষ তাতে আজীবন উপকৃত হওয়ার পরেও তা তেমনি বিদ্যমান থেকে যায়। পক্ষান্তরে অনেক জিনিস তৈরী করার সময়ই ভেঙ্গে বিনষ্ট হয়ে যায় কিংবা অটুট থাকলেও তার দ্বারা উপকার লাভের কোনো সুযোগ আসে না। অথবা উপকারে আসলেও তাতে পরিপূর্ণ উপকৃত হওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। এই বরকত মানুষের ধন সম্পদে হতে পারে, মন মস্তিস্কে হতে পারে আবার কাজ কর্মেও হতে পারে। কোনো কোনো সময় মাত্র এক গ্রাস খাদ্যও মানুষের জন্য পূর্ণ শক্তি-সামর্থ্যের কারণ হয়। আবার কোনো কোনো সময় অতি উত্তম পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য বা ঔষধও কোনো কাজে আসে না। তেমনিভাবে কোনো সময়ের মধ্যে বরকত হলে মাত্র এক ঘন্টা সময়ে এত অধিক কাজ করা যায়, যা অন্য সময় চার ঘন্টায়ও করা যায় না। এসব ক্ষেত্রে পরিমাণের দিক দিয়ে সম্পদ বা সময় বাড়ে না সত্য, কিন্তু এমনি বরকত তাতে প্রকাশ পায় যাতে কাজ হয় বহুগুণ বেশী।
[১] মূলে ‘মকর’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে, আরবীতে এর মূল অর্থ হচ্ছে, ধোকাগ্রস্ত করা। [ফাতহুল কাদীর] বা গোপনে গোপনে কোনো চেষ্টা তদবীর করা। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমনভাবে গুটি চালানো, যার ফলে তার উপর চরম আঘাত না আসা পর্যন্ত সে জানতেই পারে না যে, তার উপর এক মহা বিপদ আসন্ন। বরং বাইরের অবস্থা দেখে সে এ কথাই মনে করতে থাকে যে, সব কিছু ঠিকমত চলছে। [আল-মানার ১১/১৭৪]
তবে এ আয়াতে যে ‘মকর’ বা কৌশল অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে, তা আল্লাহর একটি গুণ। তিনি তার বিরোধীদের পাকড়াও করার জন্য যে কৌশলই অবলম্বন করেন তা অবশ্যই প্রশংসাপূর্ণ গুণ হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ, তারাও আল্লাহর সাথে অনুরূপ করে বলে মনে করে থাকে। তিনি যে রকম তার গুণও সে রকম। তার এ গুণে গুণান্বিত হবার ধরণ সম্পর্কে কেউ জানতে পারে না। এ জাতীয় আলোচনা সূরা বাকারায় বিস্তারিতভাবে করা হয়েছে। [আরও দেখুন, সিফাতুল্লাহহিল ওয়ারিদা ফিল কিতাবি ওয়াস সুনাহ]
তেরতম রুকূ’
[১] আয়াতে يَهْدِ অর্থ চিহ্নিতকরণ, প্রতীয়মান হওয়া এবং বাতলে দেয়া। এখানে এর কর্তা হল সে সমস্ত ঘটনাবলী যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান যুগের লোকেরা যারা অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসের পরে তাদের ভূ-সম্পত্তি ও ঘর-বাড়ীর উত্তরাধিকারী হয়েছে কিংবা পরে হবে, তাদেরকে শিক্ষণীয় সেসব অতীত ঘটনাবলী একথা বাতলে দেয়নি যে, কুফরী ও অস্বীকৃতি এবং আল্লাহর বিধানের বিরোধিতার পরিণতিতে যেভাবে তাদের পূর্বপুরুষেরা (অর্থাৎ বিগত জাতিসমূহ) ধ্বংস ও বিধ্বস্ত হয়ে গেছে তেমনিভাবে তারাও যদি অনুরূপ অপরাধে লিপ্ত থাকে তাহলে তাদের উপরও আল্লাহ তা'আলার আযাব ও গযব আসতে পারে। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর] আল্লাহ তা'আলা কুরআনের স্থানে স্থানে এ বিষয়টি বার বার উল্লেখ করে মানুষকে পূর্ববর্তী জাতিদের অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন। যেমন, সূরা তোয়াহা ১২৮, সুরা আস্ সাজদাহ ২৬, সূরা ইবরাহীম ৪৫, সূরা মারইয়াম ৯৮, সূরা আল-আনআম ৬, ১০, সূরা আল-আহকাফ ২৫-২৭, সূরা সাবা ৪৫, সূরা আল-মুলক ১৮, সূরা আল-হাজ ৪৫-৪৬ ৷
[২] অর্থাৎ এরা অতীত ঘটনাবলী থেকেও কোনো রকম শিক্ষা গ্রহণ করে না। ফলে আল্লাহর গযবের দরুন তাদের অন্তরে মোহর এঁটে যায়, তারা তখন কিছুই শুনতে পায় না। হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "কোনো লোক যখন প্রথমবার পাপ কাজ করে তখন তার অন্তরে মালিন্যের একটা বিন্দু লেগে যায়। দ্বিতীয়বার পাপ করলে দ্বিতীয় বিন্দু লাগে আর তৃতীয়বার পাপ করলে তৃতীয় বিন্দুটি লেগে যায়। এমনকি সে যদি অনবরত পাপের পথে অগ্রসর হতে থাকে এবং তাওবাহ না করে তাহলে এই কালি-বিন্দু তার সমগ্র অন্তরকে ঘিরে ফেলে। [দেখুন- ইবন মাজাহ ৪২৪৪] তখন মানুষের অন্তরে ভালো-মন্দকে চেনার এবং মন্দ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ তা'আলা যে স্বাভাবিক যোগ্যতাটি দিয়ে রেখেছেন, তা হয় নিঃশেষিত না হয় পরাভূত হয়ে যায়। আর তখন তার ফল দাঁড়ায় এই যে, সে ভালকে মন্দ ও মন্দকে ভাল এবং ইষ্টকে অনিষ্ট ও অনিষ্টকে ইষ্ট বলে ধারণা করতে আরম্ভ করে। এ অবস্থানটিকেই কুরআনে ران القلوب অর্থাৎ অন্তরের ‘মরচে’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর এ অবস্থার সর্বশেষ পরিণতিকেই আলোচ্য আয়াতে এবং আরো বহু আয়াতে ‘মোহর এঁটে দেয়া হয়’ বলা হয়েছে। এ অবস্থায় উপণীত হলে সত্যসেখানে প্রবেশের সুযোগ পায় না, কল্যাণের কোনো স্থান সেখানে থাকে না, যা তাদের উপকারে আসবে এমন কিছু শুনতে পায় না। শুধু সেটাই শুনতে পায় যা তাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগে। [সা'দী]
[১] অর্থাৎ তাদের অন্তর মানবিক বুদ্ধিবৃত্তির এমন একটি মনস্তাত্বিক নিয়মের আওতাধীন হয়ে যায়, যার দৃষ্টিতে একবার জাহেলী বিদ্বেষ বা হীন ব্যক্তি স্বার্থের ভিত্তিতে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার পর মানুষ নিজের জিদ ও হঠকারিতার শৃংখলে এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে যেতে থাকে যে, তারপর কোনো প্রকার যুক্তি-প্রমাণ, প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা, নিরীক্ষাই সত্যকে গ্রহণ করার জন্য তার মনের দুয়ার খুলে দেয় না। কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, এর অর্থ, যদি আমরা তাদেরকে আবার জীবিতও করতাম, তারপরও তারা ঈমান আনত না। কারণ, কুফরী ও শির্ক করা তাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। [ফাতহুল কাদীরা] কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, এখানে উদ্দেশ্য এই যে, তারা পূর্বে যখন আমি তাদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম, তখনই মিথ্যারোপ করেছিল। আল্লাহকে রব ও রাসূলদের মেনে ঈমান আনতে তখনও স্বতঃস্ফূর্তভাবে চায়নি। বরং তারা অনিচ্ছাসত্বেই ঈমানের কথা বলেছিল। সুতরাং যাতে তারা পূর্বে ঈমান আনতে অস্বীকার করেছিল তাতে তারা কখনও ঈমান আনবে না। [তাবারী; আত-তাফসীরুস সহীহ ]
[১] অর্থাৎ কোনো ধরনের অংগীকার পালনের পরোয়াই তাদের নেই। আল্লাহর পালিত বান্দা হবার কারণে জন্মগতভাবে প্রত্যেকটি মানুষ আল্লাহর সাথে যে অংগীকারে আবদ্ধ, তা প্রতিপালনের কোনো পরোয়াই তাদের নেই। তারা সামাজিক অংগীকার পালনেরও কোনো পরোয়া করে না, মানব সমাজের একজন সদস্য হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তি যার সাথে একটি সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ অন্যদিকে নিজের বিপদ-আপদ ও দুঃখকষ্টের মুহুর্তগুলোতে অথবা কোনো সদিচ্ছা ও মহৎ বাসনা পোষণের মুহুর্তে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর সাথে যে অংগীকারে আবদ্ধ হয়, তাও তারা পালন করে না। এ ধরনের অংগীকার ভঙ্গ করাকে এখানে ফাসেকী বলা হয়েছে। [সা’দী] কোনো কোনো মুফাসসিরের মতে, এখানে অঙ্গীকার বলে সে অঙ্গীকারই উদ্দেশ্য যা আল্লাহ্ তাআলা আদমের পিঠে মানুষ থেকে নিয়েছিলেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
[১] আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শনের প্রতি যুলুম করার অর্থ হল এই যে, আল্লাহ্ তা'আলার আয়াত বা নিদর্শনের কোনো মর্যাদা বুঝেনি। সেগুলোর শুকরিয়া আদায় করার পরিবর্তে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে এবং ঈমানের পরিবর্তে কুফরী অবলম্বন করেছে। কারণ, যুলুমের প্রকৃত সংজ্ঞা হচ্ছে, কোনো বস্তু বা বিষয়কে তার সঠিক স্থান কিংবা সঠিক সময়ের বিপরীতে ব্যবহার করা। সে হিসেবে মূসা ‘আলাইহিস সালাম যে সমস্ত নিদর্শন নিয়ে এসেছিলেন ফির’আউন সেগুলোর সাথে যুলুম করেছিল। অন্য আয়াতে সে যুলুমের ব্যাখ্যা এসেছে, “আর তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে নিশ্চিত সত্য বলে গ্রহণ করেছিল।" [সূরা আননামল ১৪] সুতরাং তারা সত্য জেনেও সেগুলোকে যুলুমবশতঃ অস্বীকার করেছিল। [আদওয়াউল বায়ান]
[১] মিসরীয় শাসকরা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর প্রত্যেকটি শাসক নিজেদের জন্য “ফিরআউন” (ফারাও) উপাধি গ্রহণ করে দেশবাসীর সামনে একথা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে যে, আমি-ই তোমাদের প্রধান রব বা মহাদেব। পরবর্তীতে ফিরআউন শব্দটি অহংকারী দাম্ভিক অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। কেউ যদি অহংকারী ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে তখন বলা হয়, تَفَرْعَنَ فُلَانٌ বা অমুক দাম্ভিকতা, অহংকার ও সীমালঙ্ঘনের চুড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। [কাশশাফ] কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, প্রত্যেক চক্রান্তকারী ও ষড়যন্ত্রকারীকে تَفَرْعَنَ বলা হয়। [ফাতহুল কাদীর]