[১] এখানে ف শব্দটি পূর্ববতী বাক্যের জন্য কারণ সূচক। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর] তাই অনুবাদ করা হয়েছে, “কাজেই”। আয়াতে তাসবীহ, তাহমীদ দ্বারা যিকর উদ্দেশ্য হতে পারে। [সা’দী] তাছাড়া সালাত উত্তমরূপেই আয়াতের মধ্যে দাখিল আছে বলা যায়। [কুরতুবী] এ কারণেই কোনো কোনো আলেম বলেন, এই আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও সেসবের সময়ের বর্ণনা আছে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে কেউ জিজ্ঞেস করল, কুরআনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের স্পষ্ট উল্লেখ আছে কি? তিনি বললেন, “হ্যাঁ। অতঃপর তিনি প্রমাণ হিসেবে এই আয়াত পেশ করলেন।
فَسُبْحٰنَ اللّٰهِ حِيْنَ تُمْسُوْنَ
এর অর্থ মাগরিবের সালাত, وَحِيْنَ تُصْبِحُوْنَ শব্দে ফজরের সালাত, عشياً দ্বারা আসরের সালাত এবং حين تظهرون শব্দে যোহরের সালাত উল্লেখ হয়েছে। অন্য এক আয়াতে
وَمِنۢ بَعۡدِ صَلَوٰةِ ٱلۡعِشَآءِۚ
[সূরা আন-নূর ৫৮] এশার সালাতের কথা এসেছে।” [মুস্তাদরাকে হাকিম ২/৪৪৫, নং ৩৫৪১] অবশ্য হাসান বসরী রাহেমাহুল্লাহর মতে حِيْنَ تُمْسُوْنَ শব্দে মাগরিব ও এশা উভয় সালাতই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [বাইহাকী, সুনানুল কুবরা ১/৩৫৯] সে হিসেবে এ সূরাতেই সমস্ত সালাতের উল্লেখ আছে বলা যায়। এ ছাড়াও সালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কে কুরআন মজিদে আরো যেসব ইশারা করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে: “সালাত কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরের সময় কুরআন পাঠ করো।” [সূরা আল-ইসরা ৭৮] আরো এসেছে, “আর সালাত কায়েম করো দিনের দুই মাথায় এবং রাতের কিছু অংশে।” [সূরা হূদ ১১৪] অন্যত্র এসেছে, “আর তোমার রবের প্রশংসা সহকারে তাঁর মহিমা ও পবিত্ৰতা ঘোষণা করো সূর্য উদিত হওয়ার আগে এবং তার অস্ত যাওয়ার আগে। আর রাতের কিছু সময়ও আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং দিনের প্রান্তভাগেও।" [সূরা ত্বা-হা ১৩০] এভাবে সারা দুনিয়ার মুসলিমরা আজ যে পাঁচটি সময়ে সালাত পড়ে থাকে কুরআন মজীদ বিভিন্ন স্থানে সে সময়গুলোর প্রতি ইংগিত করেছে।
[১] হাসান বসরী বলেন, এর অর্থ কাফের থেকে মুমিনকে বের করেন, আর মুমিন থেকে কাফের বের করেন। [তাবারী]
[২] যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “আর তাদের জন্য একটি নিদর্শন মৃত যমীন, যাকে আমরা সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে বের করি শস্য, অতঃপর তা থেকেই তারা খেয়ে থাকে। আর সেখানে আমরা সৃষ্টি করি খেজুর ও আঙ্গুরের উদ্যান এবং সেখানে উৎসারিত করি কিছু প্রস্রবণ।” [সূরা ইয়াসীন ৩৩-৩৪] [ইবন কাসীর]
[১] ২০ থেকে ২৭নং আয়াতসমূহে মহান আল্লাহর যেসব নিদর্শন বর্ণনা করা হচ্ছে, সেগুলো বক্তব্য পরম্পরার সাথে সম্পর্ক রেখে আখেরাতের সম্ভাবনা ও অস্তিত্বশীলতার কথা প্রমাণ করে, কেয়ামতে পুনরুজীবন, হিসাব-নিকাশ এবং শাস্তি ও প্রতিদানকে যেসব বাহাদর্শী অবান্তর মনে করতে পারতো, এ আয়াতসমূহে তাদেরকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে জওয়াব দেয়া হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর; আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]
[২] আল্লাহর কুদরাতের প্রথম নিদর্শন: প্রথম নিদর্শন এই যে, মানব জাতীকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা। মানব সৃষ্টির উপাদান যে মৃত্তিকা, একথা আদম আলাইহিস সালামের দিক দিয়ে বুঝতে কষ্ট হয় না। তিনি সমগ্ৰ মানব জাতির অস্তিত্বের মূলভিত্তি, তাই অন্যান্য মানুষের সৃষ্টিও পরোক্ষভাবে তাঁরই সাথে সম্বন্ধযুক্ত হওয়া অবান্তর নয়। [কুরতুবী] এটাও সম্ভবপর যে, সাধারণ মানুষের প্রজনন বীর্যের মাধ্যমে হলেও বীর্য যেসব উপাদান দ্বারা গঠিত, তন্মধ্যে মৃত্তিকা প্রধান। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]
[১] আল্লাহর কুদরতের দ্বিতীয় নিদর্শন: দ্বিতীয় নিদর্শন এই যে, মানুষের মধ্য থেকে আল্লাহ তাআলা নারী জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তারা পুরুষের সংগিনী হয়েছে। [ইবন কাসীর] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখবে সে যেন তার পড়শীকে কষ্ট না দেয়। আর তোমরা মহিলাদের প্রতি কল্যাণকর হওয়ার ব্যাপারে পরস্পরকে উপদেশ দাও; কেননা তারা বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বাঁকা অংশ হচ্ছে হাড়ের উপরের অংশ। যদি তুমি তাকে সোজা করতে যাও তবে তা ভেঙ্গে ফেলবে। পক্ষান্তরে যদি তুমি ছেড়ে যাও তবে সব সময় বাঁকাই থেকে যাবে। সুতরাং তোমরা মহিলাদের প্রতি কল্যাণকর হওয়ার ব্যাপারে পরস্পরকে উপদেশ দাও।” [বুখারী ৫১৮৫, ৫১৮৬]
[২] ইবন কাসীর বলেন, এর অর্থ তোমাদের স্বজাতি থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রীর ব্যবস্থা করেছেন, যাতে তোমাদের মধ্যে প্রশান্তি আসে। যেমন অন্য আয়াতে বলেছেন, “তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়।” [সূরা আল-আরাফ ১৮৯]
[৩] এখানে নারী জাতি সৃষ্টি করার রহস্য ও উপকারিতা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: অর্থাৎ তোমার তাদের কাছে পৌঁছে শান্তি লাভ কর, এ কারণেই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। পুরুষদের যত প্রয়োজন নারীর সাথে সম্পৃক্ত সবগুলো সম্পর্কে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, সবগুলোর সারমর্ম হচ্ছে মানসিক শান্তি ও সুখ। [আদওয়াউল-বায়ান; সা’দী]
[১] আল্লাহর কুদরতের তৃতীয় নিদর্শন: তৃতীয় নিদর্শন হচ্ছে আকাশ ও পৃথিবী সৃজন, বিভিন্ন স্তরের মানুষের বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি এবং বিভিন্ন স্তরের বর্ণবৈষম্য; যেমন কোনো স্তর শ্বেতকায়, কেউ কৃষ্ণকায়, কেউ লালচে এবং কেউ হলদে। এখানে আকাশ ও পৃথিবী সৃজন তো শক্তির মহানিদর্শন বটেই, মানুষের ভাষার বিভিন্নতাও আল্লাহর বিস্ময়কর ব্যাপার। ভাষার বিভিন্নতার মধ্যে অভিধানের বিভিন্নতাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আরবী, ফারসী, হিন্দী, তুর্কী, ইংরেজী ইত্যাদি কত বিভিন্ন ভাষা আছে। এগুলো বিভিন্ন ভূ-খণ্ডে প্রচলিত। তন্মধ্যে কোনো কোনো ভাষা পরস্পর এত ভিন্নরূপ যে, এদের মধ্যে পারস্পরিক কোনো সম্পর্ক আছে বলেই মনে হয় না। স্বর ও উচ্চারণভঙ্গির বিভিন্নতাও ভাষার বিভিন্নতার মধ্যে শামিল। [দেখুন, কুরতুবী; ইবন কাসীর] আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক পুরুষ, নারী বালক ও বৃদ্ধের কণ্ঠস্বরে এমন স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করেছেন যে, একজনের কণ্ঠস্বর অন্য জনের কণ্ঠস্বরের সাথে পুরোপুরি মিল রাখে না। কিছু না কিছু পার্থক্য অবশ্যই থাকে। অথচ এই কণ্ঠস্বরের যন্ত্রপাতি তথা জিহবা, ঠোঁট, তালু ও কণ্ঠনালী সবার মধ্যেই অভিন্ন ও একরূপ। [সা’দী] এমনিভাবে বর্ণ-বৈষম্যের কথা বলা যায়। একই পিতা-মাতা থেকে একই প্রকার অবস্থায় দুই সন্তান বিভিন্ন বর্ণের জন্মগ্রহণ করে। এ হচ্ছে সৃষ্টি ও কারিগরির নৈপুণ্য। [ফাতহুল কাদীর; বাগভী]
[১] আল্লাহর কুদরতের চতুর্থ নিদর্শন: মানুষের রাত্রে ও দিবাভাগে নিদ্রা যাওয়া এমনিভাবে রাত্রে ও দিবাভাগে জীবিকা অন্বেষণ করা। এই আয়াতে দিনে-রাত্রে নিদ্রাও বর্ণনা করা হয়েছে এবং জীবিকা অন্বেষণও। অন্য কতক আয়াতে নিদ্রা শুধু রাত্রে এবং জীবিকা অন্বেষণ শুধু দিনে করা হয়েছে। কারণ এই যে, রাত্রের আসল কাজ নিদ্রা যাওয়া এবং জীবিকা অন্বেষণের কাজও কিছু চলে। দিনে এর বিপরীতে আসল কাজ জীবিকা অন্বেষণ করা এবং কিছু নিদ্রা ও বিশ্রাম গ্রহণেরও সময় পাওয়া যায়। তাই উভয় বক্তব্যই স্ব স্ব স্থানে নির্ভুল। [ফাতহুল কাদীর]
[১] আল্লাহর কুদরতের পঞ্চম নিদর্শন: পঞ্চম নিদর্শন এই যে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে বিদ্যুতের চমক দেখান। এতে উহার পতিত হওয়ার এবং ক্ষতি করারও আশংকা থাকে এবং এর পশ্চাতে বৃষ্টির আশাবাদও সঞ্চয় হয়। তিনি এই বৃষ্টির দ্বারা শুষ্ক এবং মৃত মৃত্তিকাকে জীবিত ও সতেজ করে তাতে রকমারি প্রকারের বৃক্ষ ও ফল-ফুল উৎপন্ন করেন। [ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর] কাতাদাহ বলেন, এখানে যে ভয়ের কথা বলা হয়েছে তা সাধারণত মুসাফিরদের মনে উদ্রেক হয়। আর যে আশার কথা বলা হয়েছে সেটা সাধারণতঃ মুকীম বা স্থায়ী অবস্থানকারীদের মনে উদ্রেক হয়। [তাবারী]