সূরা আল-বাকারাহ্র গুরুত্ব ও ফযীলত:
[১] সূরাটি সবচেয়ে বড় সূরা।
[২] সূরাটি সবচেয়ে বেশী আহকাম বা বিধি-বিধান সমৃদ্ধ। [ইবনে কাসীর]
[৩] রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সূরা পাঠ করার বিভিন্ন ফযীলত বর্ণনা করেছেন:
আবু উমামাহ্ আল-বাহেলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর; কেননা, কেয়ামতের দিন এই কুরআন তোমাদের জন্য সুপারিশকারী হিসেবে আসবে। তোমরা দু’টি পুস্প তথা সূরা আল-বাকারাহ ও সূরা আলে-ইমরান তিলাওয়াত কর। কেননা কেয়ামতের দিন এ দু’টি সূরা এমনভাবে আসবে যেন এ দু'টি হচ্ছে দু’খণ্ড মেঘমালা, অথবা দু’টুকরো কালো ছায়া, অথবা দু’ঝাঁক উড়ন্ত পাখি। এ দু’টি সূরা যারা তিলাওাত করবে তাদের থেকে (জাহান্নামের ‘আযাবকে) প্রতিরোধ করবে। তোমরা সূরা আল-বাকারাহ্ তিলাওয়াত কর। কেননা এর নিয়মিত তিলাওয়াত হচ্ছে বারাকাহ্ বা সমৃদ্ধি এবং এর তিলাওয়াত বর্জন হচ্ছে আফসোসের কারণ। আর যাদুকররা এর উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।” [মুসলিম ৮০৪]
অপর হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা সূরা আল-বাকারাহ্ পাঠ কর। কেননা এর পাঠে বরকত লাভ হয় এবং পাঠ না করা অনুতাপ ও দুর্ভাগ্যের কারণ। যে ব্যক্তি এ সূরা পাঠ করে তার উপর কোনো আহ্লে বাতিল তথা যাদুকরের যাদু কখনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা। [মুসনাদে আহমাদ ৫/২৪৯]
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, “তোমরা তোমাদের ঘরসমূহকে কবর বানিও না। নিশ্চয়ই শয়তান ঐ ঘর থেকে পালিয়ে যায় যে ঘরে সূরা আল-বাকারাহ্ পাঠ করা হয়।” [মুসলিম ৭৮০]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, “যে ঘরে সূরা আল-বাকারাহ্ পড়া হয় সেখানে শয়তান প্রবেশ করেনা।” [মুসনাদে আহমাদ ২/২৮৪]
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “প্রত্যেক বস্তুরই উচ্চ স্তম্ভ রয়েছে, কুরআনের সুউচ্চ শৃংগ হলো সূরা আল-বাকারাহ্।” [তিরমিযী ২৮৭৮, মুস্তাদরাকে হাকিম ২/২৫৯]
[৪] রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইনের যুদ্ধের দিন সাহাবায়ে কেরামকে ডাকার সময় বলেছিলেন, “হে সূরা আল-বাকারাহ্র বাহক (জ্ঞানসম্পন্ন) লোকেরা।” [মুসনাদে আহমাদ ১/২১৮]
৫) সূরা আল-বাকারাহ্ তিলাওয়াত করলে সেখানে ফিরিশতাগণ আলোকবর্তিকার মত অবতরণ করে। এ প্রসংগে বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণনা এসেছে। [বুখারী ৫০১৮, মুসলিম ৭৯৬]
৬) যে সকল সাহাবায়ে কেরাম সূরা আল-বাকারাহ জানতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নেতৃত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করতেন এবং তাদেরকে যুদ্ধে আমীর বানাতেন। [তিরমিযী ২৮৭৬; সহীহ ইবনে খুযাইমাহ:৩/৫, হাদীস নং ১৫০৯, ৪/১৪০, হাদীস নং ২৫৪০; মুস্তাদরাকে হাকিম ১/৬১১, হাদীস নং ১৬২২]
৭) অনুরূপভাবে যারা সূরা আল-বাকারাহ এবং সূরা আলে-ইমরান জানতেন, সাহাবায়ে কেরামের নিকট তাদের মর্যাদা ছিল অনেক বেশী। [মুসনাদে আহমাদ ৩/১২০, ১২১]
৮) সর্বোপরি এ সূরাতে আল্লাহ্র “ইসমে ‘আযম” রয়েছে যার দ্বারা দো’আ করলে আল্লাহ্ সাড়া দেন। এ সূরায় এমন একটি আয়াত রয়েছে যা কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াত। এ আয়াতটি হচ্ছে আয়াতুল কুরসী, যাতে মহান আল্লাহ্ তা'আলার নাম ও গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে।
রহমান, রহীম আল্লাহ্র নামে
আলিফ্—লাম—মীম [১],
[১] আলিফ, লাম, মীম: এ হরফগুলোকে কুরআনের পরিভাষায় ‘হরূফে মুকাত্তা'আত' বলা হয়। ঊনত্রিশটি সূরার প্রারম্ভে এ ধরনের হরূফে মুকাত্তা’আত ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলোর সংখ্যা ১৪টি। একত্র করলে দাঁড়ায়:
(نَصٌّ حَكِيْمٌ قَاطِعٌ لهُ سِرٌّ)
"প্রাজ্ঞ সত্বার পক্ষ থেকে অকাট্য বাণী যাতে তার কোন গোপন ভেদ রয়েছে।" মূলতঃ এগুলো কতগুলো বিচ্ছিন্ন বর্ণ দ্বারা গঠিত এক-একটা বাক্য, যথা—(الّمص ـ حم ـ الّم) । এ অক্ষরগুলোর প্রত্যেকটিকে পৃথক পৃথকভাবে সাকিন করে পড়া হয়ে থাকে। যথা---(الف ـ لام ـ ميم) (আলিফ্-লাম্-মীম্)। এ বর্ণগুলো তাদের নিকট প্রচলিত ভাষার বর্ণমালা হতে গৃহীত। যা দিয়ে তারা কথা বলে এবং শব্দ তৈরী করে। কিন্তু কি অর্থে এবং এসব আয়াত বর্ণনার কি রহস্য রয়েছে এ ব্যাপারে মুফাস্সিরগণের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বমোট প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে চারটি:
১) এগুলোর কোন অর্থ নেই, কেবলমাত্র আরবী বর্ণমালার হরফ হিসেবে এগুলো পরিচিত।
২) এগুলোর অর্থ আছে কিনা তা আল্লাহ্ই ভাল জানেন, আমরা এগুলোর অর্থ সম্পর্কে কিছুই জানিনা। আমরা শুধুমাত্র তিলাওয়াত করবো।
৩) এগুলোর নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। কারণ, কুরআনের কোনো বিষয় বা কোনো আয়াত বা শব্দ অর্থহীনভাবে নাযিল করা হয়নি। কিন্তু এগুলোর অর্থ শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা'আলাই জানেন। অন্য কেউ এ আয়াতসমূহের অর্থ জানেনা, যদি কেউ এর কোনো অর্থ নিয়ে থাকে তবে তা সম্পূর্ণভাবে ভুল হবে। আমরা শুধু এতটুকু বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ্ তা'আলা তার কুরআনের কোনো অংশ বেহুদা নাযিল করেননি।
৪) এগুলো ‘মুতাশাবিহাত’ বা অস্পষ্ট বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। এ হিসাবে অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও ওলামার মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত মত হচ্ছে যে, হরূফে মুকাত্তা’আতগুলো এমনি রহস্যপূর্ণ যার প্রকৃত মর্ম ও মাহাত্ম্য একমাত্র আল্লাহ্ তা'আলাই জানেন। কিন্তু ‘মুতাশাবিহাত’ আয়াতসমূহের প্রকৃত অর্থ আল্লাহ্ তা'আলার কাছে থাকলেও গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেমগণ এগুলো থেকে হেদায়াত গ্রহণ করার জন্য এগুলোর বিভিন্ন অর্থ করেছেন। কোনো কোনো তাফসীরকারক এ হরফগুলোকে সংশ্লিষ্ট সূরার নাম বলে অভিহিত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, এগুলো আল্লাহ্র নামের তত্ত্ব বিশেষ। আবার অনেকে এগুলোর স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন অর্থও করেছেন। যেমন আলেমগণ (الم)– এ আয়াতটি সম্পর্কে নিম্নোক্ত মতামত প্রদান করেছেন:
১) এখানে আলিফ দ্বারা আরবী বর্ণমালার প্রথম বর্ণ যা মুখের শেষাংশ থেকে উচ্চারিত হয়, লাম বর্ণটি মুখের মধ্য ভাগ থেকে, আর মীম বর্ণটি মুখের প্রথম থেকে উচ্চারিত হয়। এ থেকে আল্লাহ্ তা'আলা উদ্দেশ্য নিয়েছেন যে, এ কুরআনের শব্দগুলো তোমাদের মুখ থেকেই বের হয়, কিন্তু এগুলোর মত কোন বাক্যো আনতে তোমাদের সামর্থ্য নেই।
২) এগুলো হলো শপথ বাক্য। আল্লাহ্ তা'আলা এগুলো দিয়ে শপথ করেছেন।
৩) এগুলো কুরআনের ভূমিকা বা চাবির মত যা দ্বারা আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর কুরআনকে শুরু করেন।
৪) এগুলো কুরআনের নামসমূহ হতে একটি নাম।
৫) এগুলো আল্লাহ্র নামসমূহের একটি নাম।
৬) এখানে আলিফ দ্বারা (أنا) (আমি) আর লাম দ্বারা আল্লাহ্ এবং মীম দ্বারা (أعْلَمُ) (আমি বেশী জানি), অর্থাৎ আমি আল্লাহ্ এর অর্থ বেশী জানি। [দেখুন: তাফসীর ইবন কাসীর ও আত-তাফসীরুস সহীহ]
৭) আলিফ দ্বারা আল্লাহ্, লাম দ্বারা জিবরীল, আর মীম দ্বারা মুহাম্মাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বোঝানো হয়েছে। [দেখুন: তাফসীর ফাতহুল কাদীর ও কুরতুবী]
৮) এভাবে এ আয়াতের আরও অনেকগুলো অর্থ করা হয়েছে। তবে আলেমগণ এসব আয়াতের বিভিন্ন অর্থ উল্লেখ করলেও এর কোনো একটিকেও অকাট্যভাবে এগুলোর অর্থ হিসেবে গ্রহণ করেননি। এগুলো উল্লেখের একমাত্র কারণ আরবদেরকে অনুরূপ রচনার ক্ষেত্রে অক্ষম ও অপারগ করে দেয়া। কারণ এ বর্ণগুলো তাদের ব্যবহৃত ভাষার বর্ণমালা এবং তারা যা দিয়ে কথা বলে থাকে ও শব্দ তৈরী করে থাকে তা থেকে নেয়া হয়েছে।
৯) মোটকথা, এ শব্দ দ্বারা আমরা বিভিন্ন অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে হেদায়াতের আলো লাভ করতে পারি, যদিও এর মধ্যকার কোন্ অর্থ আল্লাহ্ তা'আলা উদ্দেশ্য নিয়েছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে আমরা জানি না। তবে এ কথা সুস্পষ্ট যে, কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করা এ শব্দগুলোর অর্থ বুঝার উপর নির্ভরশীল নয়, অথবা এ হরফগুলোর মানে না বুঝলে কোনো ব্যক্তির সরল-সোজা পথ লাভের মধ্যে গলদ থেকে যাবে এমন কোনো কথাও নেই। তাই এর অর্থ নিয়ে ব্যাকুল হয়ে অনুসন্ধান করার এতবেশী প্রয়োজনও নেই।