[১] অর্থাৎ যদি তোমরা আশ্চর্য মনে করে থাক যে, আমরা অস্থি ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলে কিভাবে আবার পুনরুখিত হব, তাহলে তোমরা যদি পার তো পাথর বা লোহা হয়ে যাও। [তাবারী] অথবা আয়াতের অর্থ, যদি তোমরা পাথর ও লোহাও হয়ে যাও তারপরও তোমরা আল্লাহর হাত থেকে রেহাই পাবে না অথবা এর অর্থ, যদি তোমরা পাথর কিংবা লোহাও হয়ে যাও তারপরও আল্লাহ তোমাদেরকে তেমনি নিয়ে আসবেন, যেমনি তিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন। [ফাতহুল কাদীর]
[১] মুজাহিদ বলেন, এখানে যা বড় মনে হয় বলে আসমান, যমীন ও পাহাড় বোঝানো হয়েছে। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেছেন, এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, যা ইচ্ছে তা হয়ে যাও, কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে অবশ্যই মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করবেন। [ইবন কাসীর] ইবন আব্বাস, সায়ীদ ইবন জুবাইর, আবু সালেহ, হাসান, কাতাদা এবং দাহহাক বলেন, তাদের উদ্দেশ্য, মৃত্যু। কারণ, বনী আদমের কাছে এর চেয়ে বড় বিষয় আর নেই। অর্থাৎ যদি তোমরা মৃতই হয়ে যাও তারপরও তিনি তোমাদেরকে মৃত্যু দিবেন তারপর জীবিত করবেন। [ফাতহুল কাদীর]
[২] অর্থাৎ যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন তিনিই তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন। এ আয়াতে তাদের সন্দেহের দু'টি উত্তর দেয়া হয়েছে- এক. তোমাদেরকে প্রথম যিনি সৃষ্টি করেছেন সে মহান প্ৰভু সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কেমন হতে পারে? কিভাবে মনে করতে পারলে যে, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করতে পারবেন না? তোমরা তাঁর শক্তি সামর্থ সম্পর্কে এতই অজ্ঞ রয়ে গেলে? দুই. তোমরা যদি পুনরায় সৃষ্টি করাকে অসম্ভব মনে করে থাক তবে অত্যন্ত বাজে ধারণা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করছ। কারণ, তোমরা জান যে, প্রথমবার সৃষ্টি করা যত কঠিন দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা তার থেকেও সহজ কাজ। আল্লাহ্ তা'আলাই তোমাদেরকে প্রথম সৃষ্টি করেছেন তাঁর জন্য পুনরায় সৃষ্টি করা কোনো ব্যাপারই নয়। এ ধরনের আলোচনা অন্য সূরায়ও উল্লেখ করা হয়েছে। [যেমন, সূরা আর-রুম ২৭]
[৩] আরবীতে ব্যবহৃত “ইন্গাদ” শব্দের মানে হচ্ছে, উপর থেকে নিচের দিকে এবং নিচ থেকে উপরের দিকে মাথা নাড়া। এভাবে মাথা নেড়ে বিস্ময় প্রকাশ বা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হয়। [ইবন কাসীর]
[৪] তারা দুটি কারণে একথাটি বলেছে: এক. তারা পুনরুত্থানকে অসম্ভব মনে করে এভাবে উপর-নীচ মাথা ঝাকাচ্ছিল। [ইবন কাসীর] দুই. তারা এ পুনরুত্থান কেন তাড়াতাড়ি হচ্ছেনা। সে প্রশ্ন তুলছে। কুরআনের অন্যান্য আয়াতেও তাদের এ ধরনের আচরণ উল্লেখ করা হয়েছে। [যেমন, সূরা আল-মুলক ২৫, আস-শূরা ১৮]
[১] আয়াতের অর্থ এই যে, হাশরের ময়দানে যখন তোমাদেরকে ডাকা হবে, তখন তোমরা সবাই ঐ আওয়ায অনুসরণ করে একত্রিত হয়ে যাবে। ময়দানে আসার সময় তোমরা সবাই আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে উপস্থিত হবে। আয়াতের বাহ্যিক অর্থ থেকে জানা যায় যে, তখন মুমিন ও কাফের সবারই এই অবস্থা হবে। কিন্তু ইবন আব্বাস বলেন, এখানে হামদ দ্বারা তাঁর নির্দেশ ও ইচ্ছার অনুগত হয়ে যাওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে। কাতাদা বলেন, এর অর্থ তোমরা তাঁর পরিচয় জানতে পারবে এবং আনুগত্য করে তাঁর ডাকে সাড়া দিবে। কোনো কোনো তফসীরবিদ বলে, এর অর্থ হচ্ছে, আর তাঁর জন্যই যাবতীয় হামদ ও স্তুতি সর্বাবস্থায়। [ইবন কাসীর] কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হাশরের ময়দানে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করতে হবে এবং প্রত্যেক অবস্থানস্থলে মানুষের অবস্থা বিভিন্নরূপ হবে। ইমাম কুরতুবী বলেন, হাশরে পুনরুত্থানের শুরু হাম্দ দ্বারা হবে। সবাই হাম্দ করতে করতে উখিত হবে এবং সব ব্যাপারে সমাপ্তিও হাম্দের মাধ্যমে হবে। যেমন- বলা হয়েছে, “আর তাদের (হাশরবাসীদের) ফয়সালা হক অনুযায়ী করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্যে।" [সূরা আয-যুমার ৭৫]
[২] অর্থাৎ দুনিয়ায় মৃত্যুকাল থেকে নিয়ে কিয়ামতের দিনে উত্থান পর্যন্ত সময়কালটা মাত্র কয়েক ঘন্টার বেশী বলে মনে হবে না। তোমরা তখন মনে করবে, আমরা সামান্য একটু সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তার মধ্যে হঠাৎ এ কিয়ামতের শোরগোল আমাদের জাগিয়ে দিয়েছে। কুরআন তাদের এ সমস্ত কথাবার্তার বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছে। কোথাও বলেছে, “যেদিন তারা তা দেখতে পাবে সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাত অবস্থান করেছে!” [সূরা আন-নাযি'আত ৪৬]
আবার বলা হয়েছে, “যেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে এবং যেদিন আমি অপরাধীদেরকে দৃষ্টিহীন অবস্থায় সমবেত করব। সেদিন তারা নিজেদের মধ্যে চুপি চুপি বলাবলি করবে, "তোমরা মাত্র দশদিন অবস্থান করেছিলে।” [সূরা ত্বা-হা ১০২-১০৪]
আরো বলা হয়েছে, “যেদিন কিয়ামত হবে সেদিন অপরাধীরা শপথ করে বলবে যে, তারা মুহুর্তকালের বেশী অবস্থান করেনি। এভাবেই তারা সত্যভ্রষ্ট হত।” [সূরা আর-রূম ৫৫]
আবার কোথাও বলা হয়েছে, “আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে কত বছর অবস্থান করেছিলে?’ তারা বলবে, ‘আমরা অবস্থান করেছিলাম একদিন বা দিনের কিছু অংশ; আপনি না হয়, গণনাকারীদেরকে জিজ্ঞেস করুন।” তিনি বলবেন, “তোমরা অল্প কালই অবস্থান করেছিলে, যদি তোমরা জানতে!’ [সূরা আল-মুমিনুন ১১২-১১৪]
ষষ্ঠ রুকু’
[১] অর্থাৎ হেদায়াতের বিষয়টি কারও হাতে নেই। এ বিষয়টির ফায়সালা একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। তিনিই সকল মানুষের ভিতর-বাহির এবং বর্তমান-ভবিষ্যত জানেন। কার প্রতি অনুগ্রহ করতে হবে এবং তাকে তাঁর আনুগত্যের দিকে নিয়ে আসতে হবে এটা তিনিই ভাল জানেন। আর কে এ অনুগ্রহের হকদার নয় এটাও তিনি ভাল জানেন। [ইবন কাসীর]
[২] অর্থাৎ তাদের উপর আপনাকে যাবরদস্তিকারী হিসেবে পাঠাইনি যে আপনি তাদেরকে জোর করে ঈমানদার বানিয়ে ছাড়বেন। তাদের জন্য আপনাকে ‘বাশীর’ বা সুসংবাদপ্রদানকারী এবং “নাযীর’ হিসেবেই পাঠিয়েছি। তারপর যদি কেউ আপনার আনুগত্য করে তবে সে জান্নাতে যাবে আর যদি অবাধ্য হয় তবে জাহান্নামে যাবে। [ইবন কাসীর] এ অর্থে কুরআনের অন্যান্য স্থানে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। [যেমন, সূরা আল-আনআম ১০৭, আয-যুমার ৪১, আস-শূরা ৬, ক্বাফ ৪৫]
[১] যাবুর আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত একটি গ্রন্থ। আমরা ঈমান রাখি যে, আল্লাহ তা'আলা দাউদ আলাইহিসসালামকে একখানি গ্রন্থ দিয়েছিলেন যার নাম যাবুর। তবে বর্তমানে বাইবেলে যে দাউদের সংগীত নামে অভিহিত অংশ আছে তা তার গ্ৰন্থ বলা যাবে না। কারণ, এর পক্ষে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। কোনো কোনো হাদীসে দাউদ আলাইহিসসালামের গ্রন্থের নাম “কুরআন” বলা হয়েছে। তখন এর অর্থ হবে, ‘পাঠকৃত’ বা পাঠের যোগ্য। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “দাউদের উপর কুরআন সহজ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি তার বাহনের লাগাম লাগাতে নির্দেশ দিতেন। তারা তা লাগিয়ে শেষ করার আগেই তিনি তা পড়া শেষ করে ফেলতেন।” [বুখারী ৪৭১৩]
[১] এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, কেবল গায়রুল্লাহকে (আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্তা) সিজদা করাই শির্ক নয় বরং আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্তার কাছে দো'আ চাওয়া বা তাকে সাহায্য করার জন্য ডাকাও শির্ক। দো'আ ও সাহায্য চাওয়া ইবাদতেরই অন্তর্ভুক্ত। কাজেই গায়রুল্লাহর কাছে প্রার্থনাকারী একজন মূর্তি পূজকের সমান অপরাধী। তাছাড়া এ থেকে একথাও জানা যায় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ কোনো আপদ-বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে না এবং কোনো খারাপ অবস্থাকে ভাল অবস্থায় পরিবর্তিত করে দিতেও পারে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোনো সত্তা সম্পর্কে এ ধরনের বিশ্বাস রাখা ভ্ৰষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
[১] এ শব্দগুলো নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, মুশরিকদের যেসব মাবুদ ও ত্রাণকর্তার কথা এখানে বলা হচ্ছে তারা পাথরের মূর্তি নয়। বরং তারা হচ্ছে ফেরেশতা বা অতীত যুগের আল্লাহর প্রিয় বান্দা। ইবন আব্বাস বলেন, শির্ককারীরা বলত: আমরা ফেরেশতা, মসীহ ও উযায়ের এর ইবাদাত করি। অথচ যাদের ইবাদত করা হচ্ছে তারাই আল্লাহকে ডাকছে। [ইবন কাসীর] আয়াতের অর্থ পরিষ্কার। অর্থাৎ নবী হোক বা আউলিয়া অথবা ফেরেশতা, কারোই তোমাদের প্রার্থনা শুনার এবং তোমাদের সাহায্য করার ক্ষমতা নেই। তোমরা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাদেরকে আসিলায় পরিণত করছ কিন্তু তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা নিজেরাই আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী, তাঁর আযাবের ভয়ে ভীত এবং তাঁর বেশী বেশী নিকটবর্তী হওয়ার জন্য আসিলা ও উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ আয়াত নাযিল হওয়ার ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “কিছু লোক অপর কিছু জিনের ইবাদত করত, পরে সে জিনগুলো ইসলাম গ্ৰহণ করে। কিন্তু সে মানুষগুলো সে সমস্ত জিনের ইবাদত করতেই থাকল। তারা বুঝতেই পারল না যে, তারা যাদের ইবাদত করছে তারা ইসলাম গ্ৰহণ করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় এ আয়াত নাযিল হয়।” [বুখারী 8৭১৪, 8৭১৫, মুসলিম ৩০৩০]
[২] অসীলা শব্দের অর্থ, নৈকট্য অর্জন। যেমনটি কাতাদাহ রাহেমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে। [ইবন কাসীর] আল্লাহর কাছে ওসিলা হচ্ছে কথায় ও কাজে আল্লাহর মর্জির প্রতি সব সময় লক্ষ্য রাখা এবং শরীআতের বিধি-বিধান অনুসরণ করার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্যলাভে সদা তৎপর থাকা। উদ্দেশ্য এই যে, তারা সবাই সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণে মশগুল আছেন। আয়াতে রহমতের আশা এবং আযাবের ভয় করার কথা বলা হয়েছে। মূলতঃ আল্লাহর রহমতের আশা করতে থাকা এবং ভয়ও করতে থাকা মানুষের এ দু'টি ভিন্নমুখী অবস্থা যে পর্যন্ত সমান সমান পর্যায়ে থাকে, সেই পর্যন্ত মানুষ সঠিক পথে অনুগমন করে। ভয় থাকলে অন্যায় থেকে দূরে থাকবে, আর আশা থাকলে ইবাদাত ও আনুগত্যে প্রেরণা পাবে। [ইবন কাসীর] পক্ষান্তরে যদি কোনো একটি অবস্থা দূর্বল হয়ে পড়ে, তবে সেই পরিমাণে সে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, নিশ্চয় তাঁর অর্থাৎ আল্লাহর আযাব ভীতিপ্রদ। তাই আযাব থেকে ভয়ে থাকা এবং আযাবে নিক্ষেপ করে এমন কাজ করা থেকেও সাবধান থাকা উচিত। [ইবন কাসীর]
[১] কিতাব বলে এখানে ‘লাওহে মাহফুজ' বুঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর] তাদের কর্মফলের কারণেই তাদের জন্য এ শাস্তি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ধ্বংসের ব্যাপারেও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “আর আমরা তাদের উপর যুলুম করিনি, বরং তারাই তাদের নিজেদের উপর যুলুম করেছে।" [সূরা হুদ ১০১]
অন্য আয়াতে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, “কত জনপদ তাদের প্রতিপালক ও তাঁর রাসূলগণের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। ফলে আমরা তাদের কাছ থেকে কঠোর হিসেব নিয়েছিলাম এবং তাদেরকে দিয়েছিলাম কঠিন শাস্তি। তারপর তারা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করল; ক্ষতিই হল তাদের কাজের পরিণাম।” [সূরা আত-তালাক ৮, ৯]