[১] এর অর্থ এই নয় যে, বড় লাভের বিনিময়ে তা বিক্রি করতে পারো। এখানে সামান্য মূল্য’ বলে দুনিয়ার মুনাফাকে বোঝানো হয়েছে। এগুলো পরিমাণে যত বেশীই হোক না কেন, আখেরাতের মুনাফার তুলনায় দুনিয়া ও দুনিয়ার সমস্ত ধন-সম্পদ সামান্যই বটে। [ইবন কাসীর] যে ব্যক্তি আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়া গ্রহণ করে, সে অত্যন্ত লোকসানের কারবার করে। কারণ, অনন্তকাল স্থায়ী উৎকৃষ্ট নেয়ামত ও ধন-সম্পদকে ক্ষণভঙ্গুর ও অপকৃষ্ট বস্তুর বিনিময়ে বিক্রয় করা কোনো বুদ্ধিমান পছন্দ করতে পারে না।
[১] অর্থাৎ যা কিছু তোমাদের কাছে রয়েছে (এতে পার্থিব মুনাফা বোঝানো হয়েছে) তা সবই নিঃশেষ ও ধ্বংস হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর কাছে যা রয়েছে (এতে আখেরাতে জান্নাতের সওয়াব ও আযাব বোঝানো হয়েছে) তা চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে। [ইবন কাসীর]
[২] এখানে সবরের পথ অবলম্বনকারীদের বলে এমন সব লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহর নির্দেশ ও নিষেধ পালন করতে জীবনের যাবতীয় কষ্টকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে। কাফেরদের বিরুদ্ধে ধৈর্যের সাথে যুদ্ধ করেছে। এ পথে যত প্রকার কষ্ট ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় তা সবই যারা বরদাশত করে নিয়ে আনুগত্যের উপর অটল থাকে তাদের জন্য উত্তম পুরস্কার। [ফাতহুল কাদীর]
[১] সংখ্যাগরিষ্ঠ মুফাসসিরের মতে এখানে ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’ বলতে দুনিয়ার পবিত্র ও আনন্দময় জীবন বোঝানো হয়েছে। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু অর্থ করেছেন স্বল্পে তুষ্টি। দাহহাক বলেন, হালাল রিযক ও দুনিয়াতে ইবাদাত করার তাওফীক। কোনো কোনো মুফাসসিরের মতে এর অর্থ আখেরাতের জীবন। হাসান, মুজাহিদ ও কাতাদা বলেন, জান্নাতে যাওয়া ব্যতীত কারোই জীবন স্বাচ্ছন্দময় হতে পারে না। সঠিক কথা হচ্ছে, হায়াতে তাইয়্যেবা এসব অর্থের সবগুলোকেই শামিল করে। [ইবন কাসীর] প্রথমোক্ত তাফসীর অনুযায়ীও এরূপ অর্থ নয় যে, সে কখনো অনাহার-উপবাস ও অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হবে না। বরং অর্থ এই যে, মুমিন ব্যক্তি কোনো সময় আর্থিক অভাব-অনটন কিংবা কষ্টে পতিত হলেও দুটি বিষয় তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেয় না। এক- অল্পেতুষ্টি এবং অনাড়ম্বর জীবন যাপনের অভ্যাস, যা দারিদ্র্যের মাঝেও কেটে যায়। দুই- তার এ বিশ্বাস যে, এ অভাব-অনটন ও অসুস্থতার বিনিময়ে আখেরাতে সুমহান, চিরস্থায়ী নেয়ামত পাওয়া যাবে। কাফের ও পাপাচারীর অবস্থা এর বিপরীত। সে অভাব-অনটন ও অসুস্থতার সম্মুখীন হলে তার জন্য সান্ত্বনার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রায়শঃ আত্মহত্যা করে। পক্ষান্তরে সে যদি সচ্ছল জীবনের অধিকারী হয়, তবে লোভের আতিশয্য তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সে ব্যক্তি অবশ্যই সফলকাম হয়েছে যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, চলনসই মত রিযক দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছে তাতেই সে তুষ্ট হয়েছে। [মুসলিম ১০৫৪] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও দো'আ করতেন:
“হে আল্লাহ আমাকে যা রিযক দিয়েছেন তাতে তুষ্ট করে দিন এবং তাতে আমার জন্য বরকত দিন আর আমার অনুপস্থিতিতে যে কাজ হয় তা ভালভাবে শোধ করুন।” [মুস্তাদরাকে হাকেম ২/৩৫৬]
[১] কোনো কোনো মুফাসসির এ আয়াত এবং এর পূর্বের আয়াতসমূহের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করতে গিয়ে বলেন, পূর্ববতী আয়াতসমূহে প্রথমে অঙ্গীকার পূর্ণ করার প্রতি এবং সৎকর্ম সম্পাদনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ ও উৎসাহিত করা হয়েছে। শয়তানের প্ররোচনায়ই মানুষ এসব বিধি-বিধানে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। তাই এই আয়াতে বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ প্রার্থনা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। প্রতিটি সৎকর্মের বেলায় এর প্রয়োজন রয়েছে। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর] আলোচ্য আয়াতে বিশেষভাবে কুরআন পাঠের সাথে এর উল্লেখ রয়েছে। ইমাম তাবারী বলেন, সর্বসম্মত মত হচ্ছে যে, এ নির্দেশটি মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। কুরআন তেলাওয়াতের প্রথমে বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়ার কারণ হচ্ছে, যাতে শয়তান কুরআন তিলাওয়াতের সময় কোনো প্রকার ঝামেলা করতে না পারে। কোনো প্রকার সন্দেহে নিপতিত করতে না পারে এবং চিন্তা ও গবেষণা থেকে দূরে না রাখে। [ইবন কাসীর]
[২] এর অর্থ কেবল এতটুকুই নয় যে, মুখে শুধুমাত্র “আউযুবিল্লাহ" উচ্চারণ করলেই হয়ে যাবে। বরং এ সংগে কুরআন পড়ার সময় যথার্থই শয়তানের বিভ্রান্তিকর প্ররোচনা থেকে মুক্ত থাকার বাসনা পোষণ করতে হবে এবং কার্যত তার প্ররোচনা থেকে নিস্কৃতি লাভের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কুরআন তিলাওয়াত ছাড়া অন্য কোনো কালাম অথবা কিতাব পাঠ করার পূর্বে আউযুবিল্লাহ্ পড়া সুন্নত নয়। [ইবনুল কাইয়্যেম, ইগাসাতুল লাহফান] সে ক্ষেত্রে শুধু বিসমিল্লাহ পড়া উচিত। তবে বিভিন্ন কাজ ও অবস্থায় আউযুবিল্লাহর শিক্ষা হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। উদাহরণতঃ কারো অধিক ক্রোধের উদ্রেক হলে হাদীসে আছে যে, “আউযুবিল্লাহি মিনাস শায়তানির রাজীম” পাঠ করলে ক্রোধ দমিত হয়ে যায়। [দেখুন, বুখারী ৩২৮২, মুসলিম ২৬১০]
পায়খানায় প্রবেশ করার পূর্বে ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আউয়ুবিকা মিনাল খুবুসি ওয়াল খাবায়িস’ পাঠ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। [দেখুন, বুখারী ১৪২; মুসলিম ৩৭৫]
[১] এ আয়াতে ব্যক্ত হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা শয়তানকে এমন শক্তি দেননি যাতে সে যে কোনো মানুষকে মন্দ কাজে বাধ্য করতে পারে। মানুষ স্বয়ং নিজের ক্ষমতা ও শক্তি অসাবধানতাবশতঃ কিংবা কোনো স্বার্থের কারণে প্রয়োগ না করলে সেটা তারই দোষ। তাই বলা হয়েছে: যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং যাবতীয় অবস্থা ও কাজকর্মে স্বীয় ইচ্ছাশক্তির পরিবর্তে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে (কেননা তিনিই সৎকাজের তাওফীকদাতা এবং প্রত্যেকটি অনিষ্ট থেকে রক্ষাকারী) এ ধরণের লোকের উপর শয়তান আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না। সুফিয়ান সাওরী বলেন, এর অর্থ: যারা আল্লাহর উপর ভরসা রাখে শয়তান তাদেরকে এমন গোনাহে লিপ্ত করতে পারে না যা থেকে সে তাওবাহ করে না। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ: যারা আল্লাহর উপর ভরসা রাখে শয়তান তাদের কাছে কোনো প্রমাণ দিয়ে টিকে থাকতে পারে না। কারও কারও মতে, এ আয়াতটি অন্য আয়াত “তবে আমার মুখলিস বান্দাদের ব্যতীত” [সূরা আল-হিজর ৪০, সূরা ছোয়াদ ৮৩] এর অর্থের অনুরূপ। [ইবন কাসীরা] (সূরা আল-হিজরের তাফসীরে এর ব্যাখ্যা গত হয়েছে।)
[১] মুজাহিদ বলেন, এর অর্থ: যারা শয়তানের অনুসরণ করে তাদেরকেই সে পথভ্রষ্ট করে। অন্যরা বলেন, এর অর্থ: যারা তাকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদের উপরই তার প্রভাব কার্যকরী হয়। [ইবন কাসীর] আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, আর যারা তার সাথে শরীক করে, তাদের উপরও তার ক্ষমতা কার্যকর থাকে। এর আরেক অর্থ হচ্ছে, যারা শয়তানের আনুগত্যের কারণে মুশরিক হয়েছে তাদের উপরও শয়তানের প্রভাব কার্যকর। [ইবন কাসীর]
[১] “রুহুল কুদুস” এর শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে ‘পবিত্র রূহ’ বা ‘পবিত্রতার রূহ’। পারিভাষিকভাবে এ উপাধিটি দেয়া হয়েছে জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে। এখানে অহী বাহক ফেরেশতার নাম না নিয়ে তার উপাধি ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রোতাদেরকে এ সত্যটি জানানো যে, এমন একটি রূহ এ বাণী নিয়ে আসছেন যিনি সকল প্রকার মানবিক দুর্বলতা ও দোষ-ত্রুটি মুক্ত। তিনি একটি নিখাদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রূহ। আল্লাহর কালাম পূর্ণ আমানতদারীর সাথে পৌছিয়ে দেয়াই তার কাজ। তিনি যে যথার্থ কাজই করেন এবং কেবল আল্লাহর নির্দেশেরই পূর্ণ বাস্তবায়ন করেন তা আল্লাহ তা'আলা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন। [দেখুন, সূরা আল-বাকারাহ ৯৭, সূরা আস-শু'আরা ১৯২-১৯৪] [সূরা ত্বা-হা ১১৪]